শি উ ল ম ন জু রে র দী র্ঘ ক বি তা

নগরে সবুজ প্রাণের ধ্বনি

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। নগর এখন স্বপ্নের মতন

বহুদূরে অথচ নগরে যাবার জন্যে বুকের শেকলে বাঁধা এই

রঙিনজাহাজ ছুটে যাবার জন্য ছটফট করছে। নগরে পাহাড়

আছে, পর্বত আছে, ঝর্ণা আছে, নদী আছে, খাল আছে, বিল

আছে, নীল আছে, নীল সমুদ্রের গান আছে।

 

এই বর্ষায় নগরে পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, সেই জল নদীতে

নামছে, নতুন জলে নগরনদী থইথই অপরূপ হাসছে। প্রসব

বেদনায় ছুটে যাচ্ছে সোনালি রূপালি মাছেরা নতুন জলের

খামারে। এমন জলে সাঁতার দেবার কার না ইচ্ছে করে?

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। মাছরাঙা মাছের মতো ধ্যান

করে আছি, স্বপ্নের ক্যানভাসে আঁকছি নগরের দূরন্ত সবুজ

মাঠ, আঁকছি মাঠের ঘাসফড়িঙ, আঁকছি মাঠের পাশে

বনবাদাড়, আঁকছি মাঠের ছুটন্ত বাতাসে কিশোর ঘুড়ির

ছেলেবেলা, আঁকছি মাঠের কুয়াশা বিন্দু, আঁকছি মাঠের

কাদাজল, আঁকছি মাঠের সাথে বাঁধা খেলাধূলার জীবন,

আঁকছি মাঠের সাথে আরও কতোকিছু। এমন নগরেই

আটকে আছে আমার স্বপ্নের ভূবন।

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। ইশকুলে ঘন্টা পড়লো

এইবুঝি। সোনার বাংলা গাইছে আমার প্রাণ। আজও

অংকের খাতায় লাল কলমের ডিম। আজও গণিত স্যারের

কানমলা। ইংরেজি স্যার বলবেন টেন্স বুঝিস? আমি

হাবাগোবার মতো স্যারের দিকে আজও তাকিয়ে থাকি।

মৌসুমে মৌসুমে ইশকুল বাগানে নানা ফুল ফুটে। এইসব

ফুলের জন্য আমার বড় মায়া আমার বড় ভালোবাসা। আমি

ভুলে যেতে পারি না জুঁই, বেলি, শেফালি কিংবা

হাসনাহেনাদের কথা, আমি ভুলে যেতে পারি না বন্ধুর দেয়া

গোপন খাম! আমি ভুলে যেতে পারি না গোলাপ আঁকা একটি

রুমালের কথা। আপন নগরের দিকে তাকাই। নগরে পাখি

আছে প্রজাপতি আছে। পাখি ও প্রজাপতিরা প্রকৃতির

লীলাখেলায় দারুণ সুখি।
 

এই নগরে গ্রামে গ্রামে ভোরের আলোয় কৃষাণ-কৃষাণী ছুটে

যায় দূরের মাঠে। মাঠে মাঠে ধানে ধানে সবুজ প্রাণের ধ্বনি

জেগে ওঠে। প্রাণের নগরে কবি আছে কবিতার জলসা আছে,

প্রাণের নগরে নানারঙের উৎসবমাখা দিন আছে। কোনো

কোনো রাতে প্রাণের নগরে চাঁদের কিরণ নেমে আসে। সেই

কিরণে মায়াবতিরা গান ধরে। আমরা মায়াবতিদের প্রেমে

পড়ে যাই যখন তখন। নগরের পথে পথে বাউলেরা ঘুরে

ঘুরে গান গায়। বাউলেরা নগরের প্রাণ।

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। নগর প্রতিদিন ছুঁয়ে যায়

আমার এই উদভ্রান্ত হৃদয়। নগরে কত যে মেলা আর কত

যে উৎসব। বইমেলা হয়। বৈশাখি মেলা হয়। পিঠা উৎসব

হয়। ঘুড়ি উৎসব হয়। আরো কতকিছু হয়। নগরে শহীদ

মিনার আছে। স্মৃতিসৌধ আছে। মেলাতে বন্ধু নিয়ে যাই।

পরিবার প্রতিবেশি নিয়ে যাই। ভাষা শহীদদের ভালোবেসে

বেদনাশোকের গান গেয়ে গেয়ে শহীদ মিনারে যাই।

একাত্তরের হারানো ভাইবোনদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে ফুলের

মালা দিয়ে আসি। ঈদে আর পূঁজোয় সবভুলে রঙবেরঙের

কার্ডে প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা জানাই। নগরের সুখ এখনও

লেগে আছে বুকে। নগরের শোকে আজও কোমল বুক কেঁপে

ওঠে বারবার। পায়ে পায়ে লেগে আছে নদীবিধৌত উর্বর

পলিমাটির ঘ্রাণ। পায়ে পায়ে লেগে আছে মেঠোপথের

আনন্দ-ভালোবাসা। কি করে ভুলে যাই আপননগর।

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। নগরে ভোট হয়, ভোটের যুদ্ধ

হয়, হারজিত নিয়ে কাঁদাছুড়াছুড়ি হয়, কখনো কখনো

রক্তপাত হয়, পুলিশ আসে তদন্ত হয়, জেলজরিমানা কতকিছু

হয়। তবু এই নগরই আমার প্রাণ। প্রাণের নগর আমাকে

ঘুমে ও জাগরণে ডাকে। নগরের স্মৃতি নিয়ে আমি

আটলান্টিকের পাড়ে দীর্ঘশ^াসে পা ফেলি আর নগরের স্মৃতি

নিয়ে ঘুরে বেড়াই নায়াগ্রা, ঘুরে বেড়াই নিউইয়র্ক, ঘুরে

বেড়াই টরন্টো তবু জীবনের পদ্য ও গদ্যরা আমাকে নিয়ে

যায় আপন নগরে। নগরে ধূলি আছে, বালি আছে,

অক্সিজেনের অভাব আছে, দড়িবাজ আছে, দুর্নীতিবাজ আছে,

চাঁদাবাজ আছে, চাটুকার আছে, মাস্তান আছে, সুদখোর

আছে, ঘুষখোর আছে, লোভী আছে, পাপী আছে, কৃপণ

আছে সবই আছে তবু এই নগরেই ভালোরা আলোকিত করে

দিন, ভালোরা স্বপ্নদেখায় সোনালি দিন।

 

আপন নগরের দিকে তাকাই। নগরের বন্ধুরা আমার জন্যে

আজও পাতার বাঁশি বাজায়। দিগন্ত বিস্তৃত করে পাখি ও

প্রজাপতিরা আমার জন্য খুলে দেয় ভোরের পাঠশালা। মেঘ,

বৃষ্টি ও বর্ষা, সবুজ ঘাস ও শিশির বিন্দু অথবা সোনালি ধানের

মৌ মৌ গন্ধ এই মন ছুঁয়ে আছে আজও। কেউ জানে না,

বুঝে না আটলান্টিক কিংবা পটোমেকের তীরে দাঁড়ানো

ঝলমলে শহরগুলো কেড়ে নিচ্ছে আমার রক্ত ও মেধা।

#

 

শিউল মনজুর। মেরীল্যান্ড, আমেরিকা।

sheoulmanjur@gmail.com.

Print Friendly

Related Posts