নজির আহমেদ’র দশটি কবিতা

কথা

 

কথাই অশ্ব
কাঁপায় বিশ্ব,কথার ছুরি বিষাক্ত।
কথায় নিঃশ্ব
কথার খই হইহই রইরই মিছরি।

কথায় গতি
কথায় যতি
কথায় দূর্গতি
কথার ধরণে প্রকাশ পায় মতিগতি।

কথায় ভোগ
কথার রোগ বাচাল প্রকৃতি।
কথায় যোগ
কথায় বিয়োগ
কথায় নষ্ট কথায় কষ্ট
কথার ওপর ভাঙ্গে গড়ে সম্পর্ক।

কথায় আশা,ভালোবাসা
কথা সর্বনাশা।
বলিতে ব্যাকুল বোবার কন্ঠ
কথার কী যে পিপাসা!

কথা কাঁদায়,কথা হাসায়,
ভাসায় কথা,যাকে উড়ায় তাকে
ঘুড়ির মত উড়ায়।
কথার কথা বাজে কথায় ভীষণ ব্যথা
যে কথা আজও হয়নি বলা
সে কথাই শ্রেষ্ঠ কথা।

 

কবি ও কবিতা —১২

 

কোন এক চাঁদগলা শিল্পিত রাতে
আমি ও চাঁদ,কবি ও নদী একই শয্যায় পড়শি ছিলাম।
সঙ্গমসুখী রাতের পাখিরা দেখেছে
নক্ষত্রমন্ডলী জেনেছে সেই রাতে আমরা ভ্রমণবিলাসী
শব্দে শব্দে ফুল ফুটিয়েছি অন্ধকারে।

সেই নষ্টালজিক রাতের ফুল ও মৌমাছি
রোদেলা দুপুরে আজম্ম ক্ষুধার্ত আশ্রয়ে রাতটিকে খুঁজি
জোছনার শাড়ি ডুবে গেলে জলে
অনাবশ্যক ভীরুতা এসে বলে-আমার কোনো দোষ ছিলো না!

কালবেলা কথার ছুরিতে কেটেছে হৃদয়
পঁচা শামুকে পা,কোমল আবেগে বেড়েছে গোপন ঘা।
অভিমানে অভিমানে সাহসী যুবক
গভীর বিষন্নতায় ডুবে আত্মহননের রুপোলী রশিতে
ঝুলে আছি একা।

কখনো কখনো রাতের আর্তনাদে ঘোর বর্ষা নামে
কখনো কখনো নিঃশব্দ যাতনা
পোড়ায় যুগপৎ কূল থেকে অকূল স্বপ্ন-বাস্তব চিতায়।
নদীর বুকে সুরার পাত্র,ঠোঁটে মধুসরোবর
দহনের নাব্যতায় ডুবতে থাকা
চন্দন কাঠ কবি ও পাঠক,অনুবাদক ও সমালোচক।

 

সত্য মিথ্যা-২

 

স্বল্প মেয়াদি সুবিধার ভোগে দীর্ঘ মেয়াদি সুফল।
বাহ্যিক চাকচিক্যটাই যখন আসল,
সৌরভ তখন মাকাল ফল,ফাঁদপাতা নকলের জয়।
বহুল প্রচারিত মিথ্যাও একসময় সত্য মনে হয়।

মিথ্যা তো পোশাকে ঢাকা বর্ণচোরা,মুখোশে আড়াল
চোখ ধাঁধানো,মন ভোলানো নাগিন।
সত্য উলঙ্গ,ধুলোবালি চর্মে লীন;সত্যকে ধারণ করতে
ক্ষতির মুদ্রায় ঢালতে হয় বিস্তর কাবিন।

 

অধরা মাধুরী

 

থামতে চায় না দেহকাম,বেপরোয়া বেহায়া
তৃপ্ত হয় না কিছুতেই।
মিলনের কাঙ্ক্ষিত উপাসনাতে দেহই মন্দির
দেহ ভিন্ন তীর্থ নেই।

প্রবঞ্চনার স্বভাবদোষে দ্বন্দ্বমুখর অন্ধ জগৎ;
সাধন সঙ্গী হোক কান্ডারী।
গুপ্ত খবর সহজ মানুষেও ততোটা সহজ নয়
খাঁটি প্রেমে তালাশ জরুরী।

ক্ষুধার্ত পশু,তৃষ্ণার্ত পাখি
খেতে চায় পৃথিবী;চুষে নিতে চায় সমুদ্রপুরী।
শৈল্পিক পোষ মানাতে হয়,
প্রেমের শুদ্ধতায় ধরতে চাইলে অধরা মাধুরী।

 

আশা মাতাল

 

প্রতিদিন ডুবে যায় আশা
সবুজ ভালোবাসা দাবানলে ধুলি,আকুলিবিকুলি করা
স্বপ্ন জঠরে পাথর জন্মায়।
শ্বাস প্রশ্বাসে দ্রবিভূত হা হুতাশ,উপত্যকায় উপবাস,
জলাধারে আকাশ ভাঙ্গে বারোমাস।

চাঁদগলা শিল্পিত যৌবন উথলায়
মধুপুরে লুকায় নোনাজল ইলিশের গন্ধ,উর্মি দোলায়
আশ্রয় খোঁজা বালিহাঁস পুড়ে বিবর্ণ,
নিয়ত নিমগ্নতায় নিবন্ধ দৃষ্টির মন মস্তকে ঘন্টা বাজে
আজ হয় গতকাল,আগামীর আশা মাতাল।

 

পরাজিত যাযাবর

 

শরীরেই কুঁড়েঘর,বসতভিটা।দরোজায় সাঁটা
কূল এবং অকূল।রুচি তার পাশ ঘেঁষে সত্য সুন্দর
কুয়াশাস্নাত সবুজ—
নদীর নাব্যতায় ধ্যানস্থ পাহাড়,আকৃতি ত্রিভূজ।

ফাল্গুনের প্রজাপতি বসে যদি মান্দার ফুলে
হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে বের হয় দীর্ঘশ্বাস।
মিথ্যার পুষ্পার্ঘ্য জড়ানো বহুব্রীহি স্পর্শের ঘুড়ি—
কনডেম প্রেমে ব্লাউজ খোলে।
হিম কষ্টের ভ্রমণচিত্রে বারুদ সন্ধ্যা,গুলতির নিশানায়
ঘৃণার দোলনায় আমি পরাজিত যাযাবর।

 

তুমি কই

 

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ অগ্রাহ্য করে—
তোমার সান্নিধ্যে আসি।
শেকড় শুকিয়ে গেছে প্রায়,হলুদ জমাট সবুজ পাতায়
জলের ইশারায় তথাপি ত্রাস—
খাস ভূমি ছাপ কবলা স্বত্বসূত্রে ভালোবাসি।

তুমি ও আমি-পরস্পর মুখোমুখি,
বিনাবাক্যে ফোটে চুম্বকীয় কথার বিচিত্র খই।
হৃদয় লাবণ্যজ্ঞানে ত্বক তুচ্ছ—
“চাহিদামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে”র মত তোমার হই;
প্রেমে আমি তোমাকে খুঁজি,তুমি কই?

 

প্রতীক্ষা-৩

 

বাধাগ্রস্ত নিঃশ্বাস
আর ধর্ষিতা বিশ্বাসের আঁচলতলে
লুকিয়ে রেখেছি
একটি পৌড় আকাশ।

আজম্ম জম্মের পাপ
ঠাপ মারছে কামারের লাল হাঁপরে।
ক্রোধের দহন জ্বালা
বছরের পর বছর;তোমার কী খবর?

কথা ছিলো
অন্ধকারের জরায়ু ভেদ করে প্রভাকর
তুমি উদিত হবে
মুক্ত বাতাসে আমি হাসবো ভাসাব গতর।

কথা ছিলো
বিজয়ের আনন্দ লহরীতে শান্তি বইবে।
ভাঙবে খাঁচা আর
পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে নিষ্ঠুর ভালোবাসা।

কতকাল আর শুধু
কথার কথা,তোমার কথা কিংবা ইতিহাস?
সবুজ পাতার ফাঁকে
কতকাল আঁটকে থাকবে অভিমানী বাতাস?

 

বন্ধুর পথ

 

রাশভারী স্বপ্ন পুড়ছে রাবনের চিতায়
ভূঁইফোড় ঝড় গড়ে
অকুল পাথার ;হরিষে বিষাদ শাঁখের করাত
কর্মদোষে লেজগুটান।

রগচটা মন না মতি হাড় হাভাতী অগ্যতা
ধরি ঢাল প্রবোধের বরাত।
আট কপালে ভেরেন্ডা ভাজার ইতিহাস আছে
অদৃশ্য কালি ও কলমে বাজিমাৎ
বন্ধুর পথে একচাকা রথ সুযোগও সৎ আছি।

অদূরদর্শী ব্যক্তি নশ্বর কালের ভেলায় ভাসি
নদী ও নটবরের ছলা-কলায়
মাকাল ফল হাতে পেয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দেখি
প্রত্যুৎপন্নমতি অগ্রগামী;আমি উপকুলে
বন্ধুর পথে একচাকা রথে খুঁজে ফিরি গম্ভীর ধ্বনি।

নিদাঘ নিক্কনে সফলতার পানে বারংবার
সম্ভাবনা দোদুল্যমান
প্রেমাসক্ত সরোজ হৃদ্য দর্শনে বর্ষণ হয় সর্বজনীন।
প্রিয়ংবদার কন্ঠে বিবমিষার শব্দ
বনস্পতি ইশারায় জাতিস্মর অসংবৃত-মর্মস্পর্শী।

 

প্রজাপতি

 

মনে মনে একটা প্রজাপতিকে দেখি।
প্রজাপতির পতপত উড়ে যাওয়া রঙিন পাখনায়
ভর করে ভ্রমণ করি
সবুজ পাতা,গোলাপ ও গোলাপের ডাঁটায়।

ডাঁটার ভেতর থেকে কাঁটায়
লুকিয়ে থাকে যুগপৎ সুযোগসন্ধানী যমজ ভাই-বোন
সৌরভ ও সৌন্দর্য,সম্ভাবনা ও সাফল্যগাঁথা
দুঃখ-কষ্ট যমজ,ভাবছি তাদের কি মন আছে?

কন্টকাঘাতে নীলকন্ঠ ঝুলছে গাছে
অবিকল স্বপ্নের প্রজাপতি এডাল থেকে ওডালে যায়
সুখের বাগানে নীল দাবানল ছড়ায় ধ্বংসলীলায়
প্রজাপতি লেজ নাচায় লেজ নাচায়……!

Print Friendly

Related Posts