রাজধানীর ইস্কাটনে দিলু রোডের আগুন ও শিশু রুশদির মৃত্যু

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ রাজধানীর ইস্কাটনে দিলু রোডের আবাসিক ভবনে বৃহস্পতিবার ভোরে আগুন লেগে এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। ওই শিশুর বাবা-মা দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ।

ভবনে আগুন লাগার বিষয়টি টের পেয়ে শিশু সন্তান রুশদিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামছিলেন বাবা-মা, এক ফাঁকে বাবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া শিশুটি আগুন-ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে আর টিকে থাকতে পারেনি।

বৃহস্পতিবার ভোরে ইস্কাটনের দিলু রোডের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার সিঁড়িতে শিশুটির পোড়া দেহ পড়েছিল। তার বাবা শহীদুল কিরমানি রনি (৪৩) ও মা জান্নাতুল ফেরদৌসও (৩৮) মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন শহীদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ এবং জান্নাতের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

mam-1
রুশদীর পরিবারের ঘনিষ্ট সোহেল মামলুকের সঙ্গে রুশদী

রুশদীকে নিয়ে রুশদীর পরিবারের ঘনিষ্ট সোহেল মামলুক তার ফেসবুকে দেয়া একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। এখানে স্ট্যাটাসটি তুলে দেওয়া হলো-
‌‍
“উপরের ছবিটা আমার সাথে রুশদীর। গত ২৯ শে মে, ২০১৯ ইং তারিখে তোলা আমাদের অফিসে। ও এসেছিলো ওর মা Jannatul Fardaous ACMA এর সাথে। তিন ঘন্টার মতো ছিল। ওর প্রানবন্ত নিস্পাপ দূরন্তপনা আমাদেরকে মাতিয়ে রেখেছিলো সেইদিন। যার রেশ এখনও আমাদের হৃদয়ে বিদ্যমান।

গত সোমবার (২৪শে ফেব্রুয়ারী ২০২০ ইং তারিখে) জান্নাতকে বলেছিলাম – আমরা আমিরাহ্ নামিরাহ্ জেলী দলবল নিয়ে তোমাদের বাসায় হানা দিচ্ছি। জান্নাত বললো – আসেন মামলুক ভাই, রুশদী খুব খুশী হবে।

রুশদী, আর কোনদিন তোমার সাথে আমিরাহ্ আর নামিরাহ্-র (মামলুকের সদ্যজাত দুই মেয়ে) দেখা হবে না। রুশদী, আমরা তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি। তুমি যেখানেই থাকো মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তোমাকে খুব ভালো রাখেন, সর্বোচ্চ সন্মান দান করে তোমাকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন।

আজ রাজধানী ঢাকায় ইস্কাটন এলাকার দিলু রোডে নিজ বাসভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আমাদের প্রানপ্রিয় রুশদী মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রত্যাবর্তন করেছে (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

রুশদীর বাবা A. K. M. Shahidul Kirmany Rony FCMA (F-0914) এবং মা Jannatul Fardaous ACMA (A-1402) দুজনেই আমাদের ICMAB র প্রাণপ্রিয় মেধাবী সদস্য। দুজনেই প্রানোচ্ছল, সক্রিয় ও আমাদের সবার প্রিয়ভাজন।

দুজনেই মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। দুজনেই Sheikh Hasina Burn & Plastic Surgery Institute এ লাইফ সাপোর্টে আছেন। মহান করুনাময় আল্লাহতায়ালার কাছে আকুল প্রার্থনা তারা যেন দুজনেই অতি দ্রুত ও পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেন। আমিন।’

mam-2
বাবা মায়ের সঙ্গে রুশদী

এদিকে ঢাকা মেডিকেলে জান্নাতুল ফেরদৌসীর ভাই শাহাদাত হোসেন বিপ্লব বলেন, বোনের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তিনি কথা বলতে পারছে না। তবে রনি মৃদু স্বরে কথা বলতে পারছেন।

“রনি জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর তারা তিনজন তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কীভাবে যেন রুশদি তার হাত থেকে ফসকে যায়। পরে তিনিও পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নাতির পোড়া দেহ দেখে আসা রনির বাবা এ কে এম শহীদুল্লাহ ছিলেন অশ্রুসজল।

দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র প্রোডাকশন ম্যানেজার শহীদুল্লাহ বলেন, মঙ্গলবারও ছেলে রনির বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।

“রুশদিকে নিয়ে সকালবেলা এ জি চার্চ স্কুলে গিয়েছিলাম। দাদা ও নাতির সঙ্গে যে রকম খুনসুঁটি হয়, সে রকমই একটু মজা করেছিলাম,” দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলেন ষাট ছুঁই ছুঁই এই দাদা।

রনির ভগ্নিপতি মনিরুজ্জামানও মর্গে পড়ে থাকা মৃতদেহটি রুশদির বলে জানান।

স্বজনরা জানান, শহীদুল কিরমানি রনি পুলিশ প্লাজায় ‘ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার। আর তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের অর্থ বিভাগে চাকরি করেন।

তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরের ইটনা।

ভোর রাত সাড়ে ৪টার দিকে দিলু রোডের ওই পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আধা ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৫টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

আগুন নেভানোর পর ভবন থেকে শিশুটি ছাড়াও আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন একটি বায়িং হাউজের কর্মী আব্দুল কাদের লিটন এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী আফরিন জাহান জুঁথি (১৮)।

ভবনের ছাদে দেওয়ালের উপর টিন দিয়ে তৈরি ঘরে জুঁথিদের বসবাস। মেয়েটি এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষার্থী ছিলেন বলে হাতিরঝিল থানার এসআই আবুল বাশার মোল্লা জানান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে লিটনের শ্যালক জহির আলম বলেন, ‘ক্লাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটা বায়িং হাউজে চাকরি করতেন তার ভগ্নিপতি। ভবনটির গ্যারেজের পাশে ও দ্বিতীয় তলায় ওই কোম্পানির অফিস। লিটন নিচতলায় থাকতেন।

লিটনের মৃতদেহ গ্যারেজে পাওয়া যায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন। আর রুশদি ও জুঁথির মৃতদেহ ছিল তিনতলার সিঁড়িতে।

ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান বলেন, ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে তিনি থাকেন। হঠাৎ দেখতে পান গ্যারেজের একটি ইলেকট্রিক বোর্ডে আগুন লাগে। ওই বোর্ডের পাশে একটি কাঠের চৌকি দাঁড় করানো ছিল। আগুন ওই চৌকিতেও লেগে যায়। এরপর মুহূর্তের মধ্যে একটি গাড়িতে আগুন লেগে যায়।

“তখন দৌড়ে গেইটের বাইরে চলে আসি এবং আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে থাকি। আশপাশের মানুষ দৌড়ে এসে যে যার যার মতো ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়।”

আগুনে প্রাণহানির খবর শুনে সকালে দিলু রোডের ওই ভবনের সামনে ভিড় করেন উৎসুক জনতা।

আগুনে প্রাণহানির খবর শুনে সকালে দিলু রোডের ওই ভবনের সামনে ভিড় করেন উৎসুক জনতা।
এ সময় তিনি সবাইকে নিচে নামতে নিষেধ করেছিলেন জানিয়ে লুৎফর বলেন, “চিৎকার করে বলতে থাকি, ভবনের নিচে নামবেন না, নিচে অনেক আগুন সবাই ছাদে উঠে যান।”

তিনি জানান, ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাট, তৃতীয় তলায় দুটি ফ্ল্যাট, চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাট, পঞ্চম তলায় দুই ফ্ল্যাট এবং ছাদে একপাশে দেয়াল তুলে উপরে টিন দিয়ে একটি পরিবার বাস করে। সব মিলিয়ে ভবনে সাতটি পরিবারের বসবাস।

ফ্ল্যাটের বাসিন্দা প্রতিটি পরিবারই এগুলো কিনে নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ভবনের মূল মালিক আমেরিকায় থাকেন। তবে তার নাম তিনি জানেন না।

ছাদে রুম করে বসবাসকারী জুঁথির বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২) পূর্ত ভবনে প্রশাসনিক সেকশনে চাকরি করেন। তার মা লাল বানু (৩৫) গৃহিণী।

বহুতল ওই ভবনের দুটি অংশ। যে অংশে গাড়ির গ্যারেজ সেই অংশের উপরের তলায় ভবনের বাইরের অংশে কালো দাগ রয়েছে। অন্য অংশ পরিষ্কার। নিরাপত্তাকর্মী লুৎফুর রহমান বলেন, ভবনের দুটি অংশ হলেও বেরোনোর গেইট একটি।

পাশের ভবনের মালিক আকবর রশিদ বলেন, আগুন আগুন চিৎকার শুনে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। নিজের ভবনের বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেন।

পাশের আরেক ভবনের বাসিন্দা একজন নারী বলেন, “চিৎকার শুনে প্রথমে মনে করেছিলাম কোনো চুরি বা ডাকাতির ঘটনা। কিন্তু পরে ধোঁয়া দেখে বুঝলাম আগুন লেগেছে।”

দিলু রোড থেকে ভবনটিতে যেতে এই গেইটের কারণে বাধা পায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পরে পাইপ দিয়ে পানি নিয়ে নেভানো হয় আগুন।

দিলু রোড থেকে ভবনটিতে যেতে এই গেইটের কারণে বাধা পায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পরে পাইপ দিয়ে পানি নিয়ে নেভানো হয় আগুন।

দিলু রোড থেকে এই ভবনে আসতে একটি গেইট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা এগোতে হয়। ‘ইউনাইটেড ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ লেখা ওই গেইটের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে পারেনি বলে স্থানীয়রা।

প্রায় ১০০ গজ দূরে গাড়ি রেখে পাইপে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে বলে জানান তারা। ওই ভবনে আগুন নির্বাপণের কোনো বন্দেোবস্ত ছিল না।

নিচে কোনো রাসায়নিকের গুদাম ছিল কি না জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী লুৎফুর রহমান বলেন, “নিচের গুদামে কাপড়, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের কার্টন ছিল। কোনো কেমিকেল ছিল না।”

এই অগ্নিকাণ্ডে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া সুমাইয়া আক্তার (৩০), মাহাদি (৯) ও মাহমুদুল হাসান (৯ মাস) নামে আরও তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারা ওই ভবনের পঞ্চম তলার বাসিন্দা। সবাই এখন শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

Print Friendly

Related Posts