লকডাউন ও চৈতীর মা

কৃষ্ট মোহন সিংহ

 

চৈতীর বয়স সাড়ে সতেরো। দেখতে সুন্দরী হওয়ায় ঘটকের আনাগোনা বেড়েই চলছে । বয়সটা আঁঠারো হতে আর ক’দিন বাকি। কিন্তু বাবা ভাল পাত্রের খোঁজ পাওয়ায় সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না।

আষাঢ় মাস। পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বিঘে দু’ই জমিতে ধানের চারা রোপণ করলেই শ্রাবণে। ঘটকের আপত্তি, বিয়েটা পরে হোক কিন্তু কথা পাকাপোক্ত করে নেওয়া ভালো।

উপয়ান্তর না দেখে চৈতীর বাবা পাত্রী দেখাদেখির দিন ধার্য্য করেন।

মেহমান আসার দিন ঘনিয়ে এলো। সাতসকালে উঠে স্ত্রী’কে বললেন ঘরবাড়ি সাজিয়ে রাখতে আর চা কাপ প্লেট জোগাড় করতে। আর চৈতীর বাবা নিজে বাজারে গেলেন বিস্কুট চা পাতি, চিনি কিনতে। বেলা গড়িয়ে ফিরে এসে দেখেন সবই অগোছালো। আর কিছু পরই আসবে মেহমান।

চৈতীর মা পাশের বাড়িতে যায় গল্প করতে- ফেন্নার বেটা হামার মাইডাক (কন্যা) পছন্দ করিছে। ডিমেন নাই- ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজের অবহেলা দেখে চৈতীর বাবা রাগারাগি করেন। আর এতেই বাঁধে বিপত্তি। শুভদিনে কেন বকা দিবে এই ক্ষোভে চৈতীর মা বাপের বাড়ির উদ্দেশে কাপড়ের পোটলা নিয়ে বের হন।

আষাঢ় মাস নয়া বান। নদীর একূল ওকূল পানিতে থৈথৈ। ওপাড়ে বাপের বাড়ি। জিততে হবেই এ ভাবনায় চৈতীর মা ভরা নদী পার হওয়ার চিন্তা করে। অবশেষে গরুর লেজ ধরে নদীতে নেমে পড়ে।

কন্যা চৈতী’র মায়ের প্রতি দয়া হয়। এক পা দু’ পা করে এগিয়ে আসে। পিছনে পিছনে তার বাবা। তীরে এসে অবাক হয়। মাঝ নদীতে চৈতীর মা। স্ত্রী’র প্রতি মায়া হয়। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে- হারে চৈতীর মা ধরিসরে ধরিস, শক্ত করে ধরিস, ছাড়বিনে রে ছাড়বিনে। গরুর লেজ শক্ত করে ধরিস।

চরম ক্ষেপে যায় চৈতীর মা। এখনও কাজ করতে হুকুম করবে সে? ধরবোই না। ছেড়ে দেয় গরুর লেজ। মাঝ নদীতে সলিল সমাধির করুণ দৃশ্য দেখে বিচলিত হয় স্বামী ও কন্যা। ডুকরে কেঁদে ওঠে দু’জনে। এ যেন মারন লকডাউন।

গল্পটা শুনেছিলাম ছোটবেলায়। পিতার হাত ধরে এক ধর্মসভায় গিয়েছিলাম। মনে আছে এক সাধুগুরু ধর্মের দিকে মন ফেরাতে গানে গানে গল্পটা বলেছিল। করোনাভাইরাস থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে রাষ্ট্রের কতই না খরচ। চৈত্রের খরা রৌদ্রে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের রাতদিন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ। সুদূর বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইদের ফেসবুক লাইভে করুণ আকুতি আর আর্তচিৎকার তোমরা ঘরে থাকো, তোমরা ঘরে থাকো। আমাদের চারিপাশে লাশের সারি। উন্নত দেশগুলো সামাল দিতে পারছে না আর বাংলাদেশ কি করবে? তোমরা কথা মানো, অবুঝ হইও না। দেশকে বাঁচাও। কিন্তু কেউ আমরা মানছি না। সবাই আমরা চৈতীর মায়ের মতো আচরণ করছি। মাঝ নদীতে করুণ মৃত্যু আমাদের হবে বৈকি।

গত ৬ এপ্রিল টিভি’ র খবর দেখে ব্যথিত ও বিচলিত হলাম। রাস্তায় গার্মেন্টস কর্মীরা নেমে পড়েছে। একসাথে ২০০/৩০০ দলবেঁধে শ্লোগান দিচ্ছে, লকডাউন মানি না মানবো না, কাজ চাই, বেতন চাই। করোনা ভয় করিনা পেটপুরে খেতে চাই। এখনই এমন, আরো কতদিন বাকি, কি হবে- ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলছি। কাভার্ট ভ্যানে নারী পুরুষ এবং শিশু ঠাসাঠাসি করে পথচলা আরও করুণ দৃশ্য। আমার জানামতে কাভার্ট ভ্যানে কোন জানালা কিংবা এতটুকু নিঃশ্বাস নেওয়ার ছিদ্র পর্যন্ত নেই। দরজা বন্ধ করলেই অন্ধকার। কী করুণ চিত্র আমাদের! মৃত্যুকে সাথে নিয়েই আমাদের জীবন চলা। জীবনবাজি রেখে ছোট ট্রলারে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে গমন, সাগর তীরে ভেসে উঠা লাশ, আবার নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবর, সৌদি আরবে ঝি’ র কথা বলে পিতা পুত্রের যৌথ যৌনাচার সবই সহ্য করে ফেলেছি পেটের তাড়নায়।

বিশ্বায়ন জানতে বইয়ে পড়েছি আমরা সব দেশ ভাই ভাই। বিপদে একজন অন্যের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু এটাও পড়েছি পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলো নিজের লাভের দিকটাই বেশি দেখে। সাহায্যের ও সস্তা চাকরির অফার দিয়ে চুক্তি করে আর তারাই বেশি সুবিধা নেয়। আর যাতে গরীব দেশ ধনী হতে না পারে। এ বিপদের দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রী, অভিবাসীগণকে ফেরত দিতে চায় তাহলে তাদের মানবিকতা কোথায়!

সবকিছুর পরেও বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন জেলার সাথে ভিডিও কনফারেন্স শুরুতেই তিনি জাতিকে বেঁচে থাকার সাহস যুগিয়েছেন। সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষা ও জীবন নিরাপত্তার জন্য ঘোষণা করেছেন যুগোপযোগী প্রনোদনা ও নিরাপত্তা বীমা। নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধি সম্মিলিত কমিটি গঠন করে অনাহারী মানুষকে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া, এমন কি চুরি করলে কঠোর শাস্তি প্রদানের সতর্কতা ইত্যাদি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকের পরে গার্মেন্টস কর্মীরা অর্থনীতির একমাত্র চালিকাশক্তি। তাদের দিকে একটু নজর দিন। তাদের জন্য আপনি বিশাল প্রনোদনা দিয়েছেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তাদের বেতন দেওয়ার দায়িত্ব আপনি নিয়ে নিন। মালিকগণ আপনাকে তিন মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দিবে এমন ব্যবস্থা নিন। তাদের ঢাকায় থাকা, চিকিৎসা, পোশাক, সন্তানের লেখাপড়া এবং রেশনের দায়িত্ব আপনি অর্থাৎ সরকার নিয়ে নিন। ঢাকায় তাদের করুণ অবস্থা দেখতে চাই না। করোনার ভয়ে আমরা আর বিদেশে যেতে চাই না। মা-বাবা ভাই-বোন নিয়ে আমরা এ সোনার বাংলায় হাসেখিলে মিলেমিশে বেঁচে থাকতে চাই।

লেখক : প্রভাষক (যুক্তিবিদ্যা), সরকারি শহীদ আকবর আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়, বালিয়াডাঙ্গী,  ঠাকুরগাঁও।

Print Friendly

Related Posts