করোনা: প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উদ্যোগ, প্রয়োজন দ্রুত বাস্তবায়ন

মোতাহার হোসেন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের কোন দেশ এখন আর একা নয়। এখন পুরো বিশ্বটাই হচ্ছে একটি গ্লোবাল ভিলেজ। কাজেই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুপ প্রভাবে শুধু মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা বৈশ্বিক। একই সাথে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে ঠেলে দিচ্ছে৷ পাশাপাশি বিশ্বের দেশে বেকার ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। আর বৈশ্বিক এই সংকট কালে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে৷ চাকুরি হারাতে পারেন মানুষ৷ বাংলাদেশের সংকট বহুমাত্রিক হতে পারে।

করোনা ভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ৷ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্টেডিয়ামের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন৷ স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড৷ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকসানে পড়ছে বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো৷ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান৷ প্রতিদিনই ধ্বস নামছে প্রধান সব শেয়ার বাজারগুলোতে৷

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ব্যাংকিং এবং হোন্ডিং কোম্পানি জেপি মর্গান বলছে পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিবে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে৷ চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে- জানিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি৷

ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ এই অভিঘাত বাংলাদেশের উপর কতটা পড়বে? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক। তবে সরকার আগ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে৷ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ৷ অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি৷ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার৷ করোনাভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে এরিমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না৷ যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর৷ ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও৷ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তারা এরই মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ার আঁচ পেতে শুরু করেছেন৷ কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ বিক্রি এরইমধ্যে কমে গেছে, কমে যেতে শুরু করেছে ক্রেতাদের কার্যাদেশও৷ এফবিসিসিআই বলেছে, আমাদের ভয় হচ্ছে ইউরোপ নিয়ে৷ সেখানে যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে৷ মানুষ যদি ঘর থেকে বেরই না হতে পারে তাহলে পোশাক কিনবে কিভাবে? এই আশংকায় পোশাক খাত, এই খাতে কর্মরত প্রায় এক কোটি শ্রমিক কর্মচারি।

অবশ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী৷ তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি৷ এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্যে৷ যেইসব দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এরইমধ্যে কমে গেছে৷ সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমত আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না৷ তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে৷ এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে৷

করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে৷ শুধু চলতি বছর ৫০ ভাগ কমে অপরিশোধিত ব্রেরেল বিক্রি হচ্ছে ৩৩ ডলারে৷ এই পরিস্থিতি খবু সহসায় কাটবে এমন আভাস মিলছে না৷ কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীর হলে জ্বালানির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে৷ অন্যদিকে তেলের উৎপাদন কমিয়ে বাজার সামাল দেয়ার বিষয়েও একমত হতে পারেনি সৌদি আরব ও রাশিয়া৷ এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে৷ বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বড় অংশটাই কিন্তু আসে এই অঞ্চল থেকেই৷

করোনাভাইরাস ছড়ানোর মতোই দ্রুতগতিতে বাড়ছে জীবাণুর ভয়৷ সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের জীবাণু-প্রতিরোধকের চাহিদা৷ কেমিক্যাল সংস্থাগুলির বিভিন্ন পণ্যের বিক্রিও বাড়ছে৷ কিন্তু পণ্যবাহী জাহাজ চীনের সীমান্তে আটকা থাকার ফলে নতুন মাল পৌঁছতে পারছে না৷

এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স এর অবস্থা। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে৷ অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে৷ কমে যাবে বেচাকেনা৷ চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে৷ আবার বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে যাবে৷ সব মিলিয়ে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্যে৷

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির মন্তব্য, বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে৷ তাদের হিসাবে এতে মোট তিনশো কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন চাকরি হারাবে৷

অবশ্য কিছু আশা করার মতো জায়গাও রয়েছে৷ জ্বালানি তেলের পুরোটাই বাংলাদেশ বিশ্ব বাজার থেকে কেনে৷ দাম কমায় এখন আমদানি খরচ আগের চেয়ে অনেক কমে যাবে৷ সরকার যদি বাজারে সে অনুযায়ী দাম সমন্বয় করে তাহলে শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমবে৷ এতে সাধারণ মানুষও উপকৃত হতে পারেন৷ তবে সরকার জ্বালানি তেলে দাম না কমালে পুরো লাভটাই ভোগ করবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসি৷

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান৷ এর ফলে পোশাক খাতে বাংলাদেশের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে৷ ২০০ টি আন্তর্জাতিক ক্রেতা কোম্পানির উপর এই জরিপ চালানো হয়েছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে তারা চীনের বদলে এখন অন্য দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছে৷ যার মধ্যে ভিয়েতনাম, ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশও৷ তবে করোনাভাইরাস যদি বিশ্ব অর্থনীতিতেই গভীর প্রভাব ফেলে তাহলে এই সুবিধাগুলো বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে সেই প্রশ্নও রয়েছে৷ কারণ করোনাভাইরাসে এখন আতঙ্কিত সারাবিশ্ব। যার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর। এ থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। করোনাভাইরাস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশে কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর কী ধরনের বা কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলার সময় আসেনি। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থবছর শেষে এই হ্রসের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাংক সুদের হার হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ার আশংকা আছে। সার্ভিস সেক্টর বিশেষত হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন এবং এভিয়েশন সেক্টরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা হ্রাসের কারণে এর মূল্য ৫০ শতাংশের অধিক হ্রাস পেয়েছে; যার বিরূপ প্রভাব পড়বে প্রবাসী আয়ে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ দশমিক শুন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে মর্মে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন বন্ধ এবং পরিবহন সেবা ব্যাহত হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং সরবরাহ চেইনে সমস্যা হতে পারে।

চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। এর ফলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বিগত ৩ বছর ধরে ধারাবাহিক ৭ শতাংশের অধিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং সহায়ক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি। সামষ্টিক চলকসমূহের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।

এমনি এক বৈশ্বিক সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী এবং মহৎ এবং বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি এই সংকট উত্তরণে খাত ভিত্তিক গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রায় সাড়ে ৯৫ হাজার কোটি টাকার গুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে এই গুচ্ছ কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ শুরু করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন হবে প্রধানমন্ত্রীর এই গুচ্ছ কর্মসূচি। তাহলেই নিশ্চিত হবে সচল জীবন, সচল অর্থনীতি, সচল দেশ।

 

মোতাহার হোসেন : সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম ( বিসিজেএফ)।

motaherbd123@gmail.com

Print Friendly

Related Posts