খুব একা হয়ে গেলাম : সমরেশ মজুমদার

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন ওপার বাংলার প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক, দুই বাংলায় বিপুল জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার।

তিনি কলকাতা থেকে শুক্রবার সকালে টেলিফোনে বাংলাদেশে তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন ও ঘনিষ্টজন দৈনিক কালবেলার সম্পাদক আবদুল মতিনকে এই শোকের কথা জানান।

সমরেশ মজুমদার বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে আজ সবাই আমরা নিজ নিজ অবস্থানে আটকে আছি। আর এমন পরিস্থিতিতেই আমরা এই বরেণ্য ব্যাক্তিকে হারালাম

তিনি বলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমি দাদা বলতাম। আমি মনে করি আমার একমাত্র দাদা তিনি। গতকাল তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। খুব একা হয়ে গেলাম। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

ওপার বাংলার এই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক প্রায়ই বাংলাদেশে আসতেন। বাংলাদেশের সাথে তাঁর রয়েছে আত্মিক টান। বাংলাদেশে তার সাথে যাদের হার্দিক সম্পর্ক ছিল, ড. আনিসুজ্জামান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১৪ মে) বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। পরে জানা যায়, তিনি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গতবছর পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে বেড়াতে গিয়েছিলেন সমরেশ মজুমদারের সাথে। কালজয়ী কথা সাহিত্যিক সমরেশ তার প্রিয় আনিস দার মৃত্যুর পরে একান্ত আলাপে সেই জঙ্গল ভ্রমণের স্মৃতিচারণা করলেন।

তিনি বলেন, আমার জন্ম চা বাগানে এবং তাই আমাদের আড্ডায় আমি মাঝে মাঝে আনিস দাকে চা বাগানের গল্প শোনাতাম। তিনি বলতেন, একবার চা বাগান যাবেন আমার সাথে। কিন্ত তারপর তার শরীর খারাপ হলো। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যেতে হলো। সুস্থ হয়ে ফিরলেন কিন্তু চেহারা খারাপ হয়ে গেলো। তবুও গত বছর যখন কলকাতায় এলেন, আমায় বললেন তিনি এবার যাবেন চা-বাগানে আমার সাথে, সাথে স্ত্রীও ছিলেন। আমরা তিনজন গেলাম উত্তরবঙ্গের একটা চা বাগানে। চা বাগানে আমাদের খুব ভালো সময় কাটছিল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো আমরা পাশে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ঘুরতে যাব। চা বাগানের ম্যানেজার আমাদের গাইড হলেন। আর তিনি বললেন কপাল ভালো থাকলে দু-তিনটে হরিণ দেখা যেতে পারে। কারণ গাড়ির আওয়াজে জন্তু জানোয়ার জঙ্গলের ভেতরে পালিয়ে যায়।

সমরেশ মজুমদার বললেন, দুটো গাড়ি করে বেরোলাম। আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চললাম। যাবার পথে আনিস দা আমায় বললেন, আমার কপালে কোনোদিন এইসব জিনিস দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে তোমার জন্য জঙ্গলে আসা তো হলো। এইসব কথা হচ্ছে, এমন সময় কিছু বাইসন দৌড়ে এলো। ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন। আর আমাদের বললেন আপনারা কোনো কথা বলবেন না কারণ বাইসনরা খুব হিংস্র হয়। আমরা ভয়ে গাড়িতে বসে রইলাম। বাইসনরা আমাদের কিছুক্ষণ দেখলো, তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

তিনি বলেন, আমি আনিস দাকে বললাম, আপনার পণ্ডিত্বের জন্য আমাদের আক্রমণ করল না। আনিস দা বললেন, ইয়ার্কি মেরো না। আমার কিন্তু খুব ভয় করছিল। তারপরে এলো একটা গন্ডার; তারপরে একদল বুনো হাতি। একের পর এক জন্তু আসছে। আনিস দাকে দেখছে আর চলে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম। সেই ম্যানেজার আমাদের বললেন, তার এতদিনের চা বাগানের জীবনে উনি কোনদিন এতো জন্তু-জানোয়ার দেখেননি। আমি বললাম সব জন্তু-জানোয়ার যেন আনিস দাকে দেখতে এসেছিল।

স্মৃতিচারণে সমরেশ মজুমদার বলেন, তারপরে সন্ধ্যা বেলার দিকে আমরা যখন ফিরছি, গাড়ির পাশ দিয়ে দুটো হরিণ দৌড়োতে শুরু করলো। সেই ম্যানেজার আনিস দাকে বললেন, দেখেছেন স্যার আপনি এসেছেন বলে, জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার একে একে এসে আপনাকে গার্ড অব অনার দিয়ে গেল। জলদাপাড়া থেকে ফেরার পরে আনিস দা আমায় বললেন, সমরেশ বিশ্বের অনেক জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু তোমার জন্য জঙ্গলে এতো সুন্দর ঘোরা হল। আমার আমার হাত ধরে উনি ধন্যবাদ বলছিলেন। আনিস দা চলে যাবার খবরটা পাওয়ার পরে আমার জলদাপাড়ার ওই একসাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। তার সঙ্গে ২৫ বছরের বন্ধুত্ব। চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না।

Print Friendly

Related Posts