প্রসঙ্গ : ব্যাংকের আয়

সৈয়দ মহিউদ্দিন

 

ব্যাংকের ব্যয় সঙ্কোচন একটি সহজ সস্তা ও পুরানো পদ্ধতি। সংকোচন শব্দটিকে এখন আধুনিকায়ন করে পরিমিত ব্যয় বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের হিংসাত্মক প্রতিযোগিতা মূলক ব্যাংকিং মার্কেটে এই ব্যয় সংকোচন নীতি অচল। আর কর্মিদের বেতন কর্তন করে ব্যয় করা হচ্ছে মারাত্মক আত্মঘাতি।

ব্যাংকের ব্যয় সংকোচন নিয়ে ইদানিং পত্র পত্রিকায় আলোচনা এবং সমালোচনামূলক বেশ লেখালেখি চোখে পড়ছে। ব্যাংকের ব্যয় সংকোচন এবং কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন নিয়েও হচ্ছে অনেক সমালোচনা। উন্নত দেশে ব্যাংকের ব্যয় নিয়ে কর্মকর্তাদের ছাঁটাই এবং বেতন কর্তন নিয়ে আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে কর্মীদের বেতন কর্তনের পক্ষে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। অথচ উন্নত দেশের ব্যাংকিং পদ্ধতির সাথে আমাদের দেশের ব্যাংকিং পদ্ধতি আকাশ- পাতাল পার্থক্য।

পৃখিবীর উন্নত দেশে এরকম অনুন্নত তথ্য ব্যবস্থার অভাবে ঋণ ঝুঁকির অনিশ্চয়তায় থাকতে হয় না। যার কারণে নন পারফরমিং লোনের হার কম অথবা নেই বললেই চলে। এছাড়া এ দেশে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেয়ার প্রবণতা আছে। উন্নত দেশে একেবারেই পাওয়া যাবে না। যার ফলে বৈদেশিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান কোন প্রকার অনিশ্চয়তাই থাকে না। এ কারণে বিদেশি ব্যাংক ব্যবসায় সব সময় সফলতা লাভ করে। আর উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যয় সংকোচন নিয়ে তুলনা না করাই ভাল। আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোতে লাভ যতই হোক কর্মীদের প্রণোদনা দেয়া কিছুটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের দেশীয় ব্যাংকগুলোতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উপর বেতন কর্তন প্রভাব বেশি পড়ছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় মাঠ পর্যায়ে কাজ অতি সাধারণ ও সহজ। এ কাজ এতো সহজ নয়, এটা টেকনিক্যাল কাজ। এটা সব সময় চ্যালেঞ্জিং। ব্যাংকের মূল কাজই হচ্ছে, উদ্বৃত্ত অংশের জমানো টাকা সংগ্রহ করে নিরাপদ টাকা ব্যাংকে জমা করা। ( তারল্য রেখে) বাকি টাকা ঋণ হিসাবে গ্রাহকদের দেয়া। এবং ঋণের টাকা রিকভার করা। এই পুরা কাজটাই হচ্ছে মৌলিক কাজ । এই কঠিন দায়িত্বশীল কাজ করে থাকে ব্যাংকের শাখা অফিসের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।

ব্যাংক বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা। ব্যাংকিং মার্কেটে কঠোর পরিশ্রম করে ব্যবসায় সফলতার দাবিদার মাঠ কর্মীরা। সারা বিশ্বে এখন করোনা মহামারি বিরাজ করছে। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও করোনার প্রভাব পড়েছে। প্রভাব পড়েছে আর্থিকখাতে । ব্যাংকিং সেক্টরেও চলছে লকডাউন। করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং ধকল কাটাতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরই বেশি কাজ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ সফল কর্মীদের ঠুনকো অজুহাতে এই মাঠ কর্মীদেরই বেতন কর্তন করেন।

ব্যাংকের ব্রাঞ্চ বা মাঠ পর্যায়ের সকল ভেরিফিকেশন ব্রাঞ্চ পর্যায়ের কর্মীরাই করেন। আর বেতন কমিয়ে কর্মীদের থেকে সততা আর স্বচ্ছতা কিভাবেই বা আশা করা যায়। বেতন কমানো মাত্র পুরো মৌলিক কাজ তদারকিতেও ব্যাঘাত ঘটবে। এতে ব্যাংকের পুরো পোর্টফোলিওতেই আঘাত আসবে। এমনকি পুরো পোর্টফোলিওটাই রিস্কে ফেলে দেয়ার মত। অনেকের মতে, ব্যবসার দক্ষতা হচ্ছে ব্যবসা । আর ব্যবসার পরিধি হচ্ছে, বাড়ানো। ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে আয় করা। আমাদের সহজ প্রচলন হচ্ছে, ব্যয় কমিয়ে আয় দেখানো। সেটাও কর্মীদের প্রণোদনা।

ইনসেন্টিভে লভ্যাংশ, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কম দিয়ে লাভ দেখানো। মাঝে মধ্যেই আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখি, এই ব্যাংকের ১৫ বছরের সাফল্য। অমুক ব্যাংকের ২০ বছরের সাফল্য । এই সাফল্য মানে আমরা বুঝি, ঠিক পনের অথবা বিশ বছর সরাসরি লাভ করছে ব্যাংক প্রতিষ্ঠান। যেহেতু এই সাফল্যের সুফল সরাসরি ভোগ করছে মালিক কর্তৃপক্ষ। দু-এক বছর লাভ না হলে অথবা তুলনামূলক লাভ কম হলেও প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেয়ার মন মানসিকতা থাকা উচিত। ব্যাংক ব্যবসা নূন্যতম ৫০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। এত বড় ব্যবসা চালাতে উন্নত মানের মন মানসিকতা এবং ব্যবসার সাধারণ নৈতিকতা থাকতে হবে।

মালিক কর্তৃপক্ষ উদার মন মানসিকতার হলে কর্মীদের বেতন কর্তন পর্যন্ত যেতে হয়না। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত ব্যাংক ব্যবসা। কখনোই কোন বেসরকারি ব্যাংক এখনো ক্ষতির মুখ দেখেইনি। আর ব্যাংক ব্যবসা মানেই লাভ, এমন হিসাব থেকেই বের হয়ে আসতে হবে।

ইদানিং ব্যবসায় অপারেশনাল খরচ নিয়ে যাদের বেশি কথা বলতে দেখা যায়, তাদের অনেকেই নন ব্যাংকার এমনকি ব্যাংকের বেসিক অপারেশন বলতে ধারণা কম। আমি এমন একজনকে পেয়েছিলাম, তিনি খুব অভিজ্ঞ মতামত দিচ্ছিলেন, এক সময় আমি তাকে শুধু ক্রস চেকের প্রকারভেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি কোন সদুত্তর দেননি। অত্যাবশ্যকীয় খরচ, হিংসাত্মক ব্যাংকিং বাজার, গ্রাহকদের চারিত্রিক পরিবর্তন ব্যাংকের প্রতিযোগিতা ও কিছু চাকচিক্যতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

ব্যাংকারদের আয় বা বেতন বেশি- অনেক সময় এমন অনেক কথা আসে। এ ব্যাপারে আমি মনে করি, যে কোন সরকারি – বেসরকারি চাকরির মত ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এটা একটা নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রিত পেশা। ব্যাংক ব্যবসা বছরের পর বছর লাভজনক। আর এই সেক্টরে দেশ সেরা প্রথম শ্রেণীর মেধাবিরা এখনে মেধা বিক্রি করতে আসে। আর তারা তাদের মেধা সততা ও পরিশ্রম দিয়ে গ্রাহক মালিক পক্ষ তথা দেশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাই যারা ব্যাংকারদের আয় বা বেতন বেশি বলে মতামত দিচ্ছেন তাদেরর জানা দরকার যে, মেধাবী ব্যাংকার ধানমন্ডি মিরপুর থেকে গুলশান বা মতিঝিল বা বিভিন্ন এলাকা থেকে গিয়ে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তার মেধা বিক্রি করে প্রতি মাসে এক লাখ টাকা পাচ্ছে। সে যদি ব্যাংকে মেধা বিক্রি না করে গুলশান আর মতিঝিল এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে পান দোকানি করতেন তা হলে, তারা মাসে লাখ টাকা আয় করতে পারতেন। একথা গুলো বলেছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকে কর্মরত একজন ব্যাংকার। আর যারা একটা ধারাবাহিক আয় করে অভ্যস্থ, তাদের বেতন কমালে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলবে এছাড়া হতাশাগ্রস্থ সহয়ে পড়বে।

ব্যাংকে খরচ কমানোর অনেক দিক রয়েছে। যা কমালেই পরিমিত ব্যয় এর পর্যায় পড়তে পারে। ব্যাংকের দক্ষদের নিয়ে পরিচালক কমানোর ও অপটিমাস ক্যাপাসিটি মডেলিংসহ অনেকগুলো মডেল নিয়ে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মতামত ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি যা ব্যাপক সুপরিচিত। কিন্তু কোথাও ব্যাংকের কর্মীদের বেতন কর্তন নিয়ে কথা বলেনি। এমনটি অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কোন ভাবেই কর্মীদের মূল বেতনে হাত দেয়া উচিত না। এমনকি ব্যাংক অবসায়ন পর্যায়ে গেলেও না। সর্বোচ্চ কর্মীদের দেয়া লভ্যাংশ, বার্ষিক বেতন, প্রমোশন এর ব্যাপারে ভাবা যেতে পারে।

ইদানিং গ্রাহকদের চরিত্রগত পার্থক্য লক্ষ করার মত। শুধু গ্রাহক চরিত্র নিয়ে কিছু আলোচনা চললেই বুঝা যাবে। আমাদের দেশের একটা বড় অংশের চরিত্রে থাকে না সন্তোষ জনক লেনদেনের ইতিহাস। কমিটমেন্ট রাখার প্রবণতা, সঠিক তথ্য প্রকাশ করার মত প্রবণতা, ঋণ নেয়ার সঠিক উদ্দেশ্য ও সঠিক জামানত। শুধু ব্যাংকিং লগ্নি নয়। হারার পারসেজ এ গাড়ি ও হাউজ সাপ্লাই বিক্রি করে তাদের রিকভারি স্টেটম্যান্ট দেখালেই বুঝা যায়। এমনকি দশ টাকা ধার দয়া মোবাইল কোম্পানির রেকভারি স্টেটম্যান্ট দেখলে আমাদের দেশে টাকা নিলে , তা ফেরত দেয়ার জাতীয় মানসিকতার ধারণা পাওয়া যায় ।

করোনা পরবর্তিসময়ে পৃথিবীতে নতুন নতুন সেক্টর ও সম্ভাবনা আসবে। সকল ব্যাংক তাদের কর্মিদের নিয়ে একটিম হয়ে কাজ করবে। কর্মিদেও মধ্য থেকে সময়ের সেরাটা নিয়ে সকল ব্যাংকিং ও সকল প্রতিষ্ঠান ঘুরেও দাঁড়াবে। অনেকে মনে করেন, আমাদের যে ব্যাংক গুলো সেক্টর ওয়াইজ ফোকাস ছিল। যেমন কিছু কিছু ব্যাংক এস এমইফোকাস, কিছু ব্যাংক রেটেইল ফোকাস, কিছু কিছু ব্যাংক কর্পোরেট, ইসলামী তাই এই ব্যাংক গুলোকে সেক্টর ওয়াইজ এগুতে হবে । নইলে দক্ষতা ও পথ হারাতে পারে।

পরিমিত ব্যাংকের সাথে সাথে বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে বড় বড় ইনভেস্টমেন্ট আছে এমন সব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়োগের মত করে নজরদারি বাড়াতে পারে। ব্যাংকের আরএমদের কাজে লাগিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ব্যাংকের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে লগ্নি ফেরত আনতে সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকতে হবে। অনেকে এও মনে করেন, প্রত্যেক কর্মীর পিছনে আয় ও ব্যয় হিসাব করে কাজের পরিধি বের করে কাজ অনেকটা বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। সেটা দ্বিগুণ হলেও ক্ষতি নেই । এমনকি কাজ বাড়িয়ে দেয়াটা হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার । নতুন নতুন সৃষ্টিশীল ও নিরাপদ লগ্নির পথ খুঁজে সজাগ থেকে ব্যবসা করতে হবে। লগ্নি ফেরত এনে আয় বাড়িয়ে পরিমিত ব্যয় ঠিক রেখে ব্যবসা সফল হওয়াটাই হচ্ছে; বর্তমান ম্যানেজমেন্ট এর চ্যালেঞ্জ।

ভার্জিন গ্রুপের মালিক রিচার্ড ব্রানসন এর মতে, গ্রাহকরা প্রথমে আসেন না। কর্মীরা প্রথমে আসেন। আপনি যদি কর্মীর যত্ন নেন তবে কর্মীরা মন থেকে গ্রাহকের যত্ন নিবে। তাই বেতন কর্তন নয়, মেরুদন্ড সম্পন্ন সৃষ্টিশীল দক্ষ ম্যানেজমেন্ট পারবে চলমান মহামারি করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়াতে।

ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আমাদের দেশে অর্থনীতিতে, আমাদের দেহে রক্তের প্রবাহের মত। ব্যাংকিং সেক্টর ভাল থাকলে আমাদের অর্থনীতি ভাল থাকবে। মহান আল্লাহর দরবাবে প্রার্থণা করি আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভাল থাকুক, কর্মী, গ্রাহক অর্থনীতি তথা দেশ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক। সুস্থ থাকুক আমার দেশ, ভাল থাকুক আমার অর্থনীতি।

 

লেখক: চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকে কর্মরত একজন ব্যাংকার

mohi21067@gmail.com

Print Friendly

Related Posts