কামাল লোহানী আর নেই

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ কামাল লোহানী আর নেই।করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি রাজধানীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তিনি সকাল সোয়া ১০ টায় মারা যান বলে জানিয়েছেন তার ছেলে সাগর লোহানী।

সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব  কামাল লোহানীর পুরো নাম আবু নাইম মো. মোস্তফা কামাল খান লোহানী। একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংবাদিক, বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, কামাল লোহানী বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। একজন আদর্শবান ও গুণী মানুষ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের আর্দশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারালাম।

গত বুধবার (১৭ জুন) সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে কামাল লোহানীকে ভর্তি করা হয়। সেখানে নমুনা পরীক্ষার পর গতকাল শুক্রবার সকালে করোনাভাইরাস পজেটিভ রিপোর্ট আসে। পরে তাকে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

কামাল লোহানী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি শনিবার সকালে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

কামাল লোহানী ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার সনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

কামাল লোহানী এদেশের সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। চির বিদ্রোহের অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকা মানুষ।

১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে তার জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী।

মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ভাষা আন্দোলনের বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এ সময় তিনি যুক্ত হন রাজনীতিতে। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন যোগ দেন। এরই মধ্যে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। যুক্ত হন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায়।

১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় আবারও গ্রেফতার হন তিনি।

১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পারিবারিক মতবিরোধ হওয়ায় ঢাকা চলে আসেন কামাল লোহানী। চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ওই বছরই দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তার। একই বছর তিনি ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

ঢাকার আসার পরেই নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মে কামাল লোহানীর। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির হয়ে কামাল লোহানী তার নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ প্রযোজনায় অংশ নেন তিনি। পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে তিনি যান।

১৯৬০ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে বিয়ে করেন কামাল লোহানী৷ ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বরে তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর প্রয়াণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কামাল লোহানী। এ দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার ছিল দৃঢ় ভূমিকা। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন৷ ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’র সাধারণ সম্পাদক হন৷ সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বেতারের৷ দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে মনযোগী হন৷

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে বেতারের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৩ সালে সাংবাদিকতায় ফিরে এসে যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’-এ৷ ১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবার্তা’, এরপর ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করেন।

সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র এ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান।

ফলে চাকরিহীন অবস্থায় ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক হন। ১৯৭৮ সালে তাকে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) যোগ দেন। প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথনিউজ বাংলাদেশ’ েএর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার কয়েক মাস পরেই তিনি সেখানকার সহযোগী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন।

১৯৯১ সালে তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৬ মাসের মাথায় বিএনপি সরকারের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন।

২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন৷ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর৷ তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন৷ এর বাইরেও তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য৷

কামাল লোহানীর লেখা বইগুলো মধ্যে রয়েছে- ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কী’, ‘যেন ভুলে না যাই’,, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’,  ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এ দেশ আমার গর্ব’, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’,  ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ এবং কবিতার বই ‘শব্দের বিদ্রোহ’৷

কামাল লোহানী ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন৷ এছাড়াও তিনি কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা, রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা,  ক্রান্তি স্মারক, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, জাহানারা ইমাম পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন৷

Print Friendly

Related Posts