ভাড়াটে লেখক, ভাড়াটে পাঠক এবং কচুরিপানা

কামরুল হাসান দর্পণ
একটা কথা ঠিক, যিনি লিখেন, তার লেখা পরিবেশনের পর তা প্রকৃত ও সমজদার পাঠক পড়বে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ভাড়াটে পাঠকরা তা পড়ে লিখিয়েকে উচ্ছ্বাস, উল্লাস প্রকাশ করে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক।
আবার ভাড়াটে লেখকেরও অভাব নেই, যারা অর্থের বিনিময়ে অন্যের নামে লিখে থাকেন। সম্প্রতি পাঠকপ্রিয় মাসুদরানা সিরিজ নিয়ে যা ঘটেছে। এটি একটি জনপ্রিয় উদাহরণ মাত্র।
যিনি ভাড়াটে লেখক দিয়ে গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতা লেখান তারা আবার সাহিত্য মহলের প্রখ্যাতদের অর্থের বিনিময়ে বা বিভিন্ন উপঢৌকনের মাধ্যমে ক্রয় করে লেখার প্রশংসা করিয়ে থাকেন। পত্র-পত্রিকায় তাদের দিয়ে বিদগ্ধ আলোচনা করান।
প্রয়াত প্রণব ভট্টের কথা অনেকের মনে আছে কিনা জানি না। সাহিত্য মহলে বিশেষ করে একশ্রেণীর প্রখ্যাতদের সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার সাহিত্য প্রশংসায় তারা পঞ্চ থেকে ষষ্ঠ করে অসংখ্য মুখ হয়ে যেত। ঈদ সংখ্যায় তার উপন্যাস না থাকলে যেন পূর্ণতা পেত না। ঈদে তার লেখা নাটক প্রচারিত না হলে যেন ঈদ হতো না। এমনই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সাহিত্য মহলে তাঁকে নিয়ে ঢাক-ঢোল বাজতে থাকে। মূঢ়, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
আবার তাঁর এই জনপ্রিয়তা নিয়ে নানা কথাও শুনতাম। তাঁর এই সাহিত্যিক হওয়ার পেছনে আমাদেরই কোনো কোনো সিনিয়র সাংবাদিক-সাহিত্যিক নাকি ভাড়ায় খাটতেন। বিষয়টি মিথলজিতে পরিণত হয়েছিল। সিনিয়রদের যখন জিজ্ঞেস করতাম তারা হাসতেন। বিষয়টি এমন, যা বোঝার বুঝে নাও। প্রণব ভট্ট আমাকে পছন্দ করলেও, তার লেখালেখির মিথলজির কারণে লেখক হিসেবে খুব একটা পছন্দ হতো না। তবে তার অমায়িক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করত। লেখক হিসেবে তাঁর পশ্নবিদ্ধতা যে আমি পছন্দ করতাম না, তা তিনি বুঝতেন। একদিন তিনি বললেন, দ্যাখো, তুমি একা সৎ থেকে কী করবা! সারা দুনিয়া এভাবেই চলছে। আমি বলেছিলাম, দাদা, একা হলেও, একাই থাকব। তিনি আর কথা বাড়াননি।
একুশে বইমেলা এলেই দাদা ফোন দিয়ে অনেকটা নির্দেশনার সুরেই বলতেন, শোনো, বইমেলা নিয়ে তো রিপোর্ট করবা, আর আমাদের তিন জন ছাড়াতো রিপোর্ট করার মতো আর কেউ নেই। এই তিন জনের বই-ই চলে। বুঝলা, হুমায়ূন আহমেদের বই আর আগের মতো চলে না, ইমদাদুল হক মিলনের বই তো আরও চলে না। তবে হুমায়ূন আহমেদের নামটি এক নম্বরেই রাইখ, আর দুই নম্বরে আমার নামটি…না থাক, মিলনের নামই রাইখ। তারপর আমার নাম। এছাড়া আর কারও বই চলে না।
দুঃখের বিষয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিন নম্বরে তার নামটি লিখতে হতো। কারণ, ভাড়াটে পাঠকের কারণে এবং ভাড়াটে প্রখ্যাতদের কারসাজি ও তাদের এক রা –এর কারণে তাঁর বই বিক্রি তিন নম্বরেই থাকত। বইমেলায় গেলে দেখতাম, দাদা বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। একদিন ভিড়ের কারণে কাছে যেতে না পেরে দূরে দাঁড়িয়ে আছি। দাদা দেখে হাত ধরে টেনে স্টলের কাছে নিয়ে বললেন, তোমাকে দুটো বই দেই। তিনি ভালবাসার কথাবার্তা লিখে বই দুটি আমাকে দিলেন। একটির নাম সম্ভবত অভিমানী বা অভিমানে একা মেয়েটি। আরেকটির নাম মনে নেই। তখন পর্যন্ত দাদার কোনো বই আমি পড়িনি। ইচ্ছা হয়নি।
বই দুটি বাসায় গিয়ে পড়ব, এমন উত্তজনা নিয়ে ফিরে পড়তে বসে গেলাম। একটি শুরু করার পর প্রথম প্যারা পর্যন্ত যেতে পারিনি। নিশ্চিতভাবে এটা আমার ব্যর্থতা। ভাবলাম দ্বিতীয়টি শুরু করি। এটার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আমি বেকুব, এই বই পড়ার যোগ্যতা আমার হয়নি, এ বই আমাদের বিশিষ্ট সিনিয়র ভাই এবং প্রখ্যাতদের পড়ার জন্য–এই ভেবে রেখে দেই।
বিস্ময়ের ব্যাপার, দাদা মারা যাওয়ার সাথে সাথে তার সাহিত্যও মৃত্যুবরণ করে। এখন কেউ কি সাহিত্যিক প্রণব ভট্টকে মনে রেখেছে? এ নামে বাংলায় একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন, এমন স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে কি কেউ স্মরণ করে? এমনকি আমাদের প্রখ্যাত ভাইয়েরা যারা তাঁর ভাড়ায় খাটতেন, তাঁকে স্মরণ করে কি দু’কলম লিখেন? লিখেন না। কারণ তারা জানেন, প্রণব ভট্ট কেমন সাহিত্যিক ছিলেন।
হ্যাঁ, এখনও ভাড়াটে লেখক, ভাড়াটে পাঠক আছে। যারা জীবন-জীবিকার জন্য কাজটি করে। তাদের কারণে যারা আলোচনার ঝড় তোলে, মূল ধারায় তারা যে কচুরিপানার মতো ভাসে এবং ভাসতে ভাসতে এক সময় চিরতরে হারিয়ে যায়, তার অসংখ্য নজির তো দেখা যাচ্ছে। (ফেসবুক ওয়াল)
কামরুল হাসান দর্পণ : সাংবাদিক, গল্পকার।
Print Friendly

Related Posts