প্রকৌশলী বা ডাক্তারদের অন্য পেশা গ্রহণ প্রসঙ্গে

প্রকৌশলী ড. জিয়াউর ইসলাম মজুমদার

 

সম্প্রতি ৩৮তম বিসিএস-এ প্রকৌশলী আর ডাক্তারদের বিপুল সংখ্যায় বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরির সুযোগ প্রাপ্তিতে অনেককেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখছি। আবার অনেককেই নানা প্রশ্ন উত্থাপন করতে দেখছি যে, তারা কেন অন্য পেশায় যাচ্ছে? দেশের বর্তমান সিস্টেমের প্রেক্ষাপটে এই প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক!

এতো লেখা আর কমেন্টস দেখে এ ব্যাপারে দু-চারটি কথা লেখার লোভ সামলাতে পারছিনা। বর্তমান আইসিটি এক্টের বদৌলতে লেখালেখি করা খুবই রিস্ক। কোন কথা কার বিরুদ্ধে যায়, আর হয়রানীর শিকার হতে হয়! তবুও সাহস করে লিখছি।

সর্বপ্রথম আমি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক এবং আমার বাকস্বাধীনতা মহান সংবিধানে অক্ষুন্ন আছে। একজন সাবেক আইনের ছাত্র হিসেবে যতটুকু জানি, সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোন আইনই পরিত্যাজ্য। সে হিসেবে আমার গঠনমূলক ব্যাক্তিগত মতামত তুলে ধরতেই পারি। কারো বিরুদ্ধে গেলে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন প্লিজ!

আমি সর্বদাই মধ্যপন্থী চিন্তা-চেতনার লোক। আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, দেশের বর্তমান সিস্টেমের প্রেক্ষাপটে ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ারিং পড়ে অন্য পেশায় যাওয়াটা এই সেন্সে ঠিক যে,
-পড়ার জন্য পড়েছি, এখন যে পেশা আমার ভাল লাগে, আমি সে পেশায়ই যাব।
– দেশের বর্তমান সিস্টেমের কারণে যেহেতু পুলিশ আর প্রশাসনের কুক্ষিগত ক্ষমতাই দৃশ্যমান, তাই ক্ষমতার স্বাদ (!) নিতে তাদের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক! কাস্টমস বা ট্যাক্সে যেহেতু কাড়ি-কাড়ি টাকা উড়ে কিংবা পররাষ্ট্র ক্যাডারে অ্যাম্বাসেডর/হাইকমিশনার হয়ে বিদেশে ঘোরা যায়, উজ্জল ভবিষ্যতের চিন্তায় তাই এসকল ক্যাডারে যাওয়া যৌক্তিক!

যারা প্রশ্ন করছেন ডাক্তার-প্রকৌশলী হয়ে কেন অন্য পেশায় যাচ্ছে? এ প্রশ্নও যথার্থ। কারণ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রয়োজনীয় ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ারের সংখ্যা কম। তা ছাড়া, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ হতে একজনকে ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ার বানাতে পাবলিকের যে খরচ হয় তাতে তারা অন্য পেশায় গেলে দেশের ক্ষতিই হয়। ওই সমস্ত পেশায় তো সাধারণ অনার্স-মাস্টার্সই যথেষ্ট। তথাপি, ডাক্তার বা ইন্জিনিয়াররা ওই সকল পেশায় আরও ভাল করবেন এটাই স্বভাবিক।

এবার আসুন একটু ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করি। ধরুন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা দূরের আমেরিকার কতোজন বিভিন্ন ক্যাডারের অফিসারকে আপনি চিনেন? আর কতোজন ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ার বা কৃষিবিদকে চেনেন? মানুষ চারপাশের বাস্তুগত বা স্বাস্হ্যগত বা খাদ্যগত সমস্যায় কার কাছে যায়? দেশ বা সমাজের কল্যাণে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়? এসকল উত্তরে যদি একজন ইন্জিনিয়ার বা ডাক্তার বা একজন কৃষিবিদের চেহারা সবার আগে আপনার মনের মানসে ভেসে উঠে, তবে বলবো এসকল পেশার লোকজন অন্য পেশায় যাওয়া মানে নিজের মহান পেশা থেকে নিজকে বঞ্চিত করা।

হ্যাঁ, এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যে, রাষ্ট্র একজন মেধাবী পেশাজীবীকে তার দায়িত্বপালনে তাকে কাজে লাগাতে পারেনি। রাষ্ট্র তার যোগ্য মেধাবীকে মূল্যায়ন করতে পারেনি, পারেনি যথাযথ মর্যাদা দিতে। ধরুন, একটা অনুষ্ঠানে বা সভায় কথার ৯০%ই প্রযুক্তিগত বা স্বাস্হ্যগত। এসকল বিষয়ে যারা মূল্যবান কথা বলবেন তারা ডায়াসের সামনে জনগণের সাথে। বাকী ভিআইপিরা (!) ডায়াসে বসে আছেন। এখন একজন প্রকৌশলী হয়ে যদি আপনি মনে করেন, ইস! অমুক ক্যাডারে গেলে হয়তো ডায়াসে বসতে পারতাম! আমি বলবো, এ চিন্তাই অবান্তর। সেখানে আপনার মেধার মূল্যায়ন করার কেউ কি আছে? তো আপনি কার কাছে সেই মূল্যায়ন প্রত্যাশা করেন? এ সকল হীন সিস্টেমের উপর ক্ষেপে আপনি নিজের মহান পেশা ছেড়ে তথাকথিত ক্ষমতার রাজ্যে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সেটা কতোটুকু যৌক্তিক সময়ই ভাল বলতে পারবে!

এটা পরীক্ষিত যে, নিম্ন আয়ের দেশ বা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে যেখানে পার ক্যাপিটা ইনকাম ১০০০-২০০০ ডলারের কাছাকাছি, এসকল অনেক দেশেই সাধারনত অটোকেটিক বা সেমি-অটোক্যাটিক বা নাম মাত্র গণতন্ত্রের সরকার বিদ্যমান থাকে। সরকার তার ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে বুঝে হোক বা না বুঝে হোক কিছু শ্রেণির আমলাদের বুদ্ধি-পরামর্শের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নেপথ্যে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার চেয়ে শ্রেণিগত কিছু আমলাদের ক্ষমতা বেশি থাকে। এসকল দেশে পেশাজীবীদের মূল্যায়ন সমানুপাতিকভাবে আশা করাটা হাস্যকর। যতই দাবী পেশ করা হোক না কেন, একটা পর্যায়ে তা স্তিমিত হতে বাধ্য।উন্নত দেশের চিত্র ভিন্ন। অতএব, আমরা নিরুপায়। সিস্টেমকে যতটুকু সম্ভব মানিয়ে নিতে হবে, যতদুর সম্ভব দাবী আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যারা অন্য ক্যাডারে চাকরি নিচ্ছে তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হবার কোন কারণ খুঁজে পাইনা! কারণ, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সকল কর্মকর্তারা ডাক্তার-প্রকৌশলীদের যতটুকু সম্মান দেয়, এরা সেটার ব্যাপারে আরও কৃপণ হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এবং এদের দ্বারা পেশাজীবীদের কোন উপকার হবে বলেও আমি বিশ্বাস করিনা। তবুও তাদের সাধুবাদ জানাই, একটা ভাল চাকরি পেয়েছে। ওই সকল পদে তারা যদি তাদের মেধার প্রজ্জলন ঘটায়, দেশ আরও ভালো সার্ভিস পাবে।

হিটলারের একটা উক্তি আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। সেটা হলো-If you don’t like a system, Just follow it, Climb up and change the Rule.

এটা সম্ভব, ডাক্তার-প্রকৌশলীদের বেশী-বেশী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া। এমপি হয়ে দেশের কল্যাণে, সকলের কল্যাণে কাজ করা, কোন প্রকার স্বজন-প্রীতি বা একচোখা মনোভাব আমি কখনোই সমর্থন করিনা। ভবিষ্যতেও করবো না। দশের কল্যাণ যাতে নিহিত, সেটাই সমর্থন করি।

প্রকৌশলী ড. জিয়াউর ইসলাম মজুমদার: সাবেক আইনের ছাত্র, কবি ।

Print Friendly

Related Posts