পদ্মা সেতু-রেল সেক্টর : এ যেন যুদ্ধের মধ্যেও আরেক যুদ্ধ জয়

এএইচএম নোমান

 

পদ্মা সেতু এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ রেল মন্ত্রণালয়- বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর তদারকিতে চীনা কন্সট্রাকশন কোম্পানীর অবকাঠামো এবং জেলা-উপজেলা ও স্থানীয় সরকার প্রশাসন সহযোগীতায় মাঠে এনজিও ডরপ এর পুনর্বাসন কার্যক্রম, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্যাগ ও দানের ফসল এই সেক্টর এগিয়ে আছে। ফ্রন্ট ফাইটিং আর্মি যেমন আছে বিরামহীনভাবে অগ্রযাত্রায়, তেমনি গেরিলা ফাইটিং এ বেসামরিক কর্মযজ্ঞের সৈনিকরাও কোন অংশে পিছিয়ে নাই। কেননা সংশ্লিষ্ট সকলের রণকৌশলসহ জেতার দৃঢ়তা ছিল একই। ১০ জুন ২০২০ দিনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু’র ৩১তম স্প্যান বসান হয়েছে। মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি: মিটারের মধ্যে ৪.৬৫ কি:মি: সেতু দৃশ্যমান হলো। করোনার প্রকৃতির প্রতিশোধ তান্ডব পরিস্থিতির মধ্যেও পদ্মার এই থমকে না থাকার জয়গান আমাদের সকলের গর্ব। এ ছিল ‘পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করব’ দূরদর্শী নামাজি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাহসী ঘোষণা।

করোনা মানুষকে মানুষ থেকে দূরত্ব করে ফেললেও সেতু-রেল লাইন স্থাপন এবং পুনর্বাসন কাজে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের কাজ থেকে রেলওয়ে, সেনাবাহিনী, পরামর্শক দল এবং এনজিও সংশ্লিষ্ট কর্মী-কর্মকর্তাদেরকে দূরে রাখতে পারেনি। যুদ্ধ জয়ে সম্মুখে পশ্চাতে অগ্রযাত্রাকে, গেরিলা কায়দায় বাঁধা বিপত্তিকে কিভাবে উৎরিয়ে এগুতে হয়েছে তার কয়েকটি ছিন্ন জীবন যুদ্ধ ঝুঁকি কথা। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শ্রীনগর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোরসহ ৯টি জেলা নেটওয়ার্কিং রেল সংযোগ দীর্ঘ ১৬৪ কি:মি:। সব স্থানেই জীবন ঝুঁকি। এলাকায় মাইকিং লিফলেট বিতরণসহ করোনা যুদ্ধ সামলানো সাবধানতায় বার্তা ছিল ‘নিয়মিত হাত ধোন’। শারীরিক দূরত্ব ও মানসিক শক্তি বজায় রাখুন। কাজ ও কাজকে উপভোগ করুন। প্রয়োজনে ১৬২৬৩/৩৩৩ ফোন করি। করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকি। রমজানের পবিত্রতায় শুকরিয়া’।

গ্রাম দেশের প্রথম ধাক্কা আসে ১৯ মার্চ শিবচর উপজেলা, প্রশাসন করোনা আক্রান্ত এলাকা র্ডপ এর সূর্যনগর কার্যালয়সহ পুরো লকডাউন করে। এপ্রিল মাসে সীমিত এবং মে মাস থেকে কার্যক্রম পরিচালনায় ভবনের মালিক-স্থানীয়দের বাধাঁ ও অসহযোগিতামূলক আচরনে স্টাফরা অন্তরীন হয়ে পড়ে। সুপারভাইজার শফিকুজ্জামান, পুনর্বাসন কর্মী নরুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলাম এবং কম্পিউটার অপারেটর মোঃ মনিরুল ইসলাম করোনা উপসর্গ নিয়ে অসুস্থতায় ভুগেছে। বর্তমানে সুস্থ। বেজগাঁও, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ অফিস ভবনের মালিক ক্ষতিগ্রস্থ ও সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগে নানা প্রশ্ন তুলে বাসা ছাড়তে হয়। বদলীকৃত বা নুতন স্টাফদের চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি। পাবলিক যানবাহনে ২/৩ গুণ ভাড়ার চলতে হয়। শ্রীনগর অফিসের পূনর্বাসন কর্মী মোঃ শহিদুল ইসলামের সিজনাল ফ্লু হলেও ভবনের মালিক এবং এলাকাবাসীয় চাপে দ্রæত সরিয়ে নিতে হয়। প্রকল্প আওতায় আডুয়াকান্দি, ভাংগা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোর জেলাসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্থদের তথ্য সংগ্রহে বাড়ী বাড়ী যাওয়া, আসায় এলাকাবাসীর বাধাঁ ছিল প্রতিনিয়ত। জনপ্রতিনিধিগণ করোনা ভয়ে সাক্ষাত দেন না। চর যশোরদি ইউপি সচিব করোনায় আক্রান্ত। ইউপি অফিসে কেউ আসে না। নগরকান্দা উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের পিএস এর জ্বর হয়েছে, চেয়ারম্যান সাহেব অফিস করেন না। ক্ষতিগ্রস্থরা ভয় আতংকে মুখোমুখি হয়ে সাক্ষাৎ দিতে চান না। কর্ম যুদ্ধ পথে যেখানেই করোনা সন্দেহ, সেখানেই ১৪ দিন হোম কোয়াটান্টোইনে থেকে কাজ করছে, তবুও কাজ ফেলে সরে আসেনি কেউ। হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মীদের মেসে থাকতে হয়। বাজারে গেলে খারাপ মন্তব্য করে। মুদি দোকানদার বাকিতে বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়, কখন কে আক্রান্ত হয়- মারা যায়। জয়নগর, কাশিয়ানীর পুনবার্সন কর্মী সন্তান সম্ভবা জান্নাতুল ফেরদৌসকে বাড়ীর মালিক গ্রামে ঘোরা ঘুরি করেন অভিযোগ এনে তার মা তাকে বাসায় ঢুকতে দেয়নি এবং তার থেকে রুমের চাবি নিয়ে নেয়।

নাকসী মাদ্রাসা বাজার, নড়াইল কার্যক্রমে বাঁধাদান এবং অফিস অবরোধ করেন। সেনাবাহিনী ও ডরপ’র আলোচনায় ফাস্ট ট্র্যাক কাজের গুরুত্বে সন্ধি হয়। জয়পুর পারছাতরা ও তুলারামপুর মৌজায় ১৬ জন করোনা রুগী সনাক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য বিধি মেনে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তরা করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আর আসবেন না জানান দেয়। টাইম লাইন ও কাজ সম্পাদন-মাইলষ্টোন মিলানো, ভূমি আইনের জটিল নিয়ম কানুন ঠিক রাখা ছিল বাস্তব সমস্যা। নড়াইলের পূনবার্সন কর্মী কাকলী আক্তার, মাসুদা বেগম ও সোহেলী আক্তারকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আঃ আজিজ ও বাড়ীর মালিক পারভেজ মিয়া তাদের ভাড়া বাড়ি থেকে তাৎক্ষনিক বের করে দেন। তারপরেও স্টাফরা অফিসের গেস্টরুমে অবস্থান করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন করে কেউ বাড়ি ভাড়াও দিচ্ছেনা। চারাভিটা বাজার, বাঘারপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে ঘন ঘন যেতে নিষেধ করছে।

গ্রামের সাধারণরা করোনা মোকাবিলায় সচেতন নয়, ফলে স্টাফদের সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ছে। লুকোচুরি- যুদ্ধাবস্থা। তারপরেও এগিয়ে চলছে, গর্বের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ কার্যক্রম। এ যেন মানুষ ও অবকাঠামো উন্নয়নের এক সংযোগ জয়ের পালাগান। করোনা ভাইরাস আযাব সারা বিশ্বে একই রকম- ধরন সংবাদ। তম্মধ্যেও পদ্মা সেতু-রেলের কর্ম যজ্ঞের জয় সংবাদ ভিন্ন। স্বনির্ভরতার প্রতীক। পবিত্র কুরআনের ১৩ পারার সূরা রা’দ এর সেই বাণী মনে করিয়ে দেয় যে ‘অবশ্যই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে’। পদ্মা সেতু ও রেল লাইন সংযোগ দুটো কাজই নিজের পায়ে দাঁড়ানো-দর্শনের জন্য সাহস ও দূরদর্শী অনুপ্রেরনার সিঁড়ি। দেশের উন্নয়ন ও পেশা উঁচুতার পরিমাপক।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিমিত্তে চীনা বা সেনাবাহিনীর কর্ম আবাসিক এলাকায় গাড়ি ও মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। কিন্তু কোন পক্ষই যুদ্ধে পিছুটান দেয়নি। অনলাইন ফোন আধুনিক টেকনোলোজি ব্যবহার করে কাজের গুরুত্ব ও টাইম লাইন ঠিক রেখে সবই চলছে যুদ্ধ জয়ের দিকে। যে চীনে বিধ্বংসী করোনার উৎপত্তি সেই চাইনিজরাই আবার বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যেও গেরিলা বা সম্মুখযোদ্ধা, যখন যেভাবে প্রয়োজন কাজ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আইসোলেশন, লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ রেল মন্ত্রণালয়, প্রকল্প পরিচালক – টিম সংশ্লিষ্টরা তীর চোখে তদারকি করছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে একজন মেজর জেনারেলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদা সতর্ক।

ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ক্ষতিপূরণ বিষয়ক জটিল জমি জমা গাছ গাছালি পুকুর ধর্মীয় স্থাপনা কবরাদি হিসাব প্রস্তুতি তৈরীতে আইএনজিও ডরপ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন কেউ যেন পিছিয়ে নাই জয়ের প্রত্যয়ে। এ যেন যুদ্ধের মধ্যেও আরেক যুদ্ধ। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় অনুমোদিত পুনর্বাসন পরিকল্পনার ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। একই সংগে বিভিন্ন কারণ বা মৃতজনিত কারণে ওয়ারিশ ঝামেলা বেড়েছে। টাইম বাউন্ড ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আরো জমি অধিগ্রহণ ও ব্যয় বৃদ্ধিসহ তৎসংশ্লিষ্ট কাজ বেড়ে যাচ্ছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (দের) পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে ২৫ মে ২০২০ মাঠ পর্যায়ে কাশিয়ানীতে উপস্থিত থেকে মানসিক শক্তি ও উৎসাহ প্রদান ছিল ব্যতিক্রমীয়। উভয় ফেইজে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, বৈঠক-পর্যালোচনা করোনা ভাইরাস, আম্পান ঝড় বৃষ্টি, ভয় আশংকা, আতংক সব কিছুকে উঁপচিয়ে টিম এগিয়ে চলছে যুদ্ধ জয়ের পথে। এ যেন সবার এগিয়ে যাওয়ার পালা, পড়তে হবে জীবন-জীবিকার মালা। রুখতে হবে বৈষম্য। আনতে হবে সাম্য। গড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর শোষনহীন সোনার বাংলা।

এজন্য ‘আমরা আর মামুরা’র ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ (পিপিপি) নীতিমালার বৈষম্যের পথ বন্ধ ও মালিকানা আনার লক্ষ্যে ‘পুওর’ যোগ করে ‘পাবলিক প্রাইভেট পুওর পার্টনারশিপ’র (পিপিপিপি) নীতিমালা প্রণয়নের দাবী করছি। যাতে কল্যাণী সরকারের সকল পুনর্বাসন কার্যক্রমের ক্ষতিগ্রস্তরা ঝুঁকিপূর্ণ নাড়ী কাটা দরিদ্ররা আর যাতে তলানীতে না যায়, এর আওতায় আসে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, উচ্ছেদকৃত ঝুঁকিপূর্ণ অবিত্তবান ক্ষতিগ্রস্তরা অনূর্দ্ধ ১০ শতাংশের বেশী হয়না। প্রস্তাবিত পিপিপিপি’র আওতায় ঝুঁকিপূর্ণদেরকে রেল, সড়ক, সেতু, নৌ-পরিবহন, ওয়াসা পানি, গ্যাস-লাইন ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্ডের মাধ্যমে টোল ফ্রি চলাচল ও মালামালপন্য পরিবহন করবে। ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পুনর্বাসন নীতিমালায় ক্ষতিগ্রস্তদের অংশিদারী ও মালিকানা বিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এসডিজির ১ নম্বর এজেন্ডা এন্ডিং পোভার্টি লক্ষ্য মাত্রা কার্যকর হবে। সৃষ্ট বৈষম্যের থাবায় হুদ, সামুদ ও কারুনের খালাতো ভাইয়েরা দেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা ৮৪ হাজার। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় দূর্নীতির বিষ বৃক্ষ উপড়ে ফেলার যুদ্ধ ঘোষণার প্রত্যয়ণ পত্র এ প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় আরেকটি মেগা প্রকল্প বাংলাদেশ নৌ বাহিনী পরিচালিত পায়রা সমুদ্র বন্দর আবাসন ও প্রশিক্ষণসহ সমন্বিত পুনর্বাসন কর্ম যজ্ঞে একই জয়ের সুর। তবে সারাদেশে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসের পার্সেন্টেজ কাজ কারবারের কথা আলাদা।

প্রকল্পটি ২টি পর্যায়ে বিভক্ত। ফেইজ-১ ঢাকা হতে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০১৭ সালের ১ ফেব্রæয়ারি শুরু হয়ে ৩১ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত চলবে। ফেইজ-২ ভাঙ্গা হতে যশোর পর্যন্ত ০১ জানুয়ারি ২০২০ এ শুরু হয়েছে যা ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত চলবে। উভয় ফেইজে মোট ৭৯৯.৭৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পে মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১২,৬২৩ জন। যাদের মধ্যে ১৮০৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ঝুঁকিপূর্ণ ও দরিদ্র। এদেরকে জীবিকা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন আওতায় কারিগরি ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। উভয় ফেইজে মোট ৬৫৭ কোটি টাকা রিসেটেলমেন্ট বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা কৃষি জমি, বসতভিটা, বাণিজ্যিক, শিল্প জমি, জলাশয়ের ক্ষতি, শিল্পকারখানা, গাছপালা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (আয়ের সাময়িক ক্ষতি কৃষি মজুর ও ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা) ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ পাবে।

এএইচএম নোমান: কলামিস্ট, উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠক।
ই-মেইল: nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts