স্মরণ॥ কথা সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের ৩১তম প্রয়াণ দিবস আজ।  ১৯৮৮ সালের ২৪ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আবু জাফর শামসুদ্দীন ছিলেন একজন প্রগতিশীল লেখক।  উদার দৃষ্টিভঙ্গি, গভীর মানবিকতাবোধ ও সমাজপ্রগতির ভাবনা তাঁর চরিত্রের বিশেষ দিক।  তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট সোসাইটি, বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহি পরিষদ, বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চপদে আসীন ছিলেন।

উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীনের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়।  তাঁর প্রথম উপন্যাস পরিত্যক্ত স্বামী প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে।  উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি গল্প এবং প্রবন্ধও রচনা করেন।  তাঁর রচনায় গণমানুষের সংগ্রাম ও উদার মানবতাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়।  তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো- উপন্যাস: ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান, পদ্মা মেঘনা যমুনা, সংকর সংকীর্তন ও দেয়াল।

গল্পগ্রন্থ: জীবন, রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, ল্যাংড়ী।  শিল্পীর সাধনা ও পার্ল বাকের সেরা গল্প তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ’।

প্রবন্ধ: চিন্তার বিবর্তন ও পূর্ব পাকিস্তানী সাহিত্য, Sociology of Bengal Politics, সোচ্চার উচ্চারণ, লোকায়ত সমাজ ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি ইত্যাদি।

এ ছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি জীবনী, আত্মজীবনী, নাটক, ভ্রমণকাহিনী এবং স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচনা করেন।

১৯১১ সালের ১২ মার্চ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের দক্ষিণবাগ গ্রামে তাঁর জন্ম।  মৃত্যুর পর ৩২ বছরেও জন্মস্থানে এই কথা সাহিত্যিকের নামে গড়ে উঠেনি কোন স্থাপনা।  এমনকি তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তাকে মনে করা হয়না।

বাবার জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে স্থানীয়ভাবে কোন অনুষ্ঠান বা তাঁর নামে স্থানীয়ভাবে কেন কোন স্থাপনা গড়ে উঠেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে ছেলে আহমেদ পারভেজ শামসুদ্দীন বলেন, ‘বাবা আবু জাফর শামসুদ্দীন শুধু কালীগঞ্জের মানুষ ছিলেন না।  তিনি বাংলাদেশ ও দেশের বাইরেও তাঁর ডাক নাম ছিল।  তাই পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর জন্ম ও প্রয়াণ দিবসকে ঘিরে কোন আচার অনুষ্ঠান বা উনার নামে স্থাপনা তৈরির কোন দাবি তোলা হয়নি।  তবে পরিবারের মানুষ হিসেবে এ দাবি তোলাটা স্পর্শকাতর বিষয়।  তাকে যদি কেউ মনে রেখে কোন কিছু করতে চায় তবে পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই। ‘

এই কথা সাহিত্যিকের দক্ষিণবাগ গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে আবু জাফর শামসুদ্দীন ও তার স্ত্রীর কবরসহ কয়েকটি কবর আগাছায় ভরে গেছে।  পুরো বাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে।  তবে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে।  তাঁর নামে গ্রামের পুরো সম্পত্তি আবু জাফর শামসুদ্দীন ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার খাতুন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।  এই জমি থেকে লিজের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থে ট্রাস্টের মাধ্যমে সামাজিক কাজ করা হয় বলে জানালেন ছেলে আহমেদ পারভেজ শামসুদ্দীন।  গ্রামের একমাত্র কথা ও কবিতা নামের একমাত্র পাঠাগারটিও এই ট্রাস্ট পরিচালনা করছে।

দক্ষিণবাগ গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মোজাম্মেল হক সরকার জানান, আবু জাফর শামসুদ্দীন মাছ ধরা খুব পছন্দ করতেন, তাই গ্রামে আসলেই বরশি নিয়ে বিলে মাছ ধরতেন তিনি।  এছাড়া গ্রামের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে বাউল গানের আয়োজন করতেন।

একই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ বোরহান উদ্দিন আকন্দ নান্নু জানান, আবু জাফর শামসুদ্দীন একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মানুষ।  ঢাকা থেকে গ্রামে আসলে গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন এবং খুতবা দিতেন।

এ প্রজন্মের তরুণ অ্যাডভোকেট লোকমান হোসেন জানান, ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় পাঠ্য বইতে তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়েছেন।  তাছাড়া গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে তার অনেক গল্প শুনেছেন বলে জানান তিনি।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিক জানান, বিষয়টি তার জানা ছিল না।  তবে তিনি দেশের এত বড় একজন মানুষ হিসেবে তাঁর জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু হওয়া উচিত ছিল।

তিনি বলেন, ‘আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিবারের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  গুণী এই মানুষটির জন্ম ও মৃত্যু দিবসে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে।

আবু জাফর শামসুদ্দীনের ৪ ছেলে ও ৫ মেয়ের সবাই প্রতিষ্ঠিত।  তবে জ্যেষ্ঠ কন্যা ও কনিষ্ঠ ছেলে মৃত্যুবরণ করেছেন।  তার পিতার নাম মোহাম্মদ আক্কাছ আলী ভুঁইয়া।  পিতামহ নাদিরুজ্জামান ভুঁইয়া মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর শিষ্য ছিলেন। নিজ গ্রামের প্রভাত পন্ডিতের পাঠশালায় আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়।  ১৯২৪ সালে তিনি জুনিয়র মাদ্রাসা ও ১৯২৯ সালে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।  পরে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দেন।  তিনি দৈনিক সোলতান পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়।  পরে তিনি খুলনা, কলকাতা ও কটকে কিছুকাল সরকারি চাকরি করেন।  এর পাশাপাশি তিনি আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও সংবাদ পত্রিকায় বিভিন্ন পদে চাকরি করেন।  মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ‘অল্পদর্শী’ ছদ্মনামে দৈনিক সংবাদে ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’ শীর্ষক সাপ্তাহিক কলাম লিখে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।  এর আগে তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে সহকারী অনুবাদ পদে নিযুক্ত ছিলেন।

আবু জাফর প্রথম জীবনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (এম.এন রায়) ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  পরে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ (১৯৫৭) গঠিত হলে তার প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।  তিনি ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন।  ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

সমাজ ও সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৮ সালে আবু জাফর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ স্মৃতিপদক ও মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে মৃত্যুর পর ফিলিপস পুরস্কার লাভ করেন।

 

কালীগঞ্জ (গাজীপুর)/শাহ মতিন টিপু

Print Friendly

Related Posts