পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা: অন্যতম দায়ী পলিথিন ও প্লাস্টিক

 ম্যাকি ওয়াদুদ

আমাদের চারপাশে দুই নয়ন মেলে আমরা যা কিছু দেখি বা অনুভব করি অর্থাৎ আকাশ-বাতাস, নদী-নালা, রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, মানুষজন, জীবজন্তু, গাছপালা সবই পরিবেশ। মানুষ এই প্রকৃতির সন্তান হলেও মানুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরিবেশ সুন্দর ও সজীব রাথা এবং সৌরভ ছড়ানো।

মানুষের বেঁচে থাকা, জম্ম-মৃত্যু, জীবন-জীবিকা সবকিছুই পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশ সুন্দর, সজীব ও বিশুদ্ধ রাখলে মানুষের বেঁচে থাকা, লালন-পালন ও জীবন-জীবিকা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা অনেকটা সহজ হয়ে যায় আর পরিবেশ দুষিত করলে মানুষের জীবন-যাত্রায় খুব জটিল ও কঠিন প্রভাব পড়ে। মানুষ সুস্থ্য-সুন্দরভাবে সুখী সমৃদ্ধিশালী হয়ে বেঁচে থাকা ও জীবন ধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশকে বিভিন্ন দূষণের কবল থেকে রক্ষা করা এবং বিশুদ্ধ ও সুন্দর, সজীব-সবুজ রাখা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

বেশি দিন আগের কথা নয় সেই ১৯৮২/৮৩ এর কথা। আমি সবে প্রাথমিব বিদ্যালয় শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের গ্রাম থেকে এক মাইল দূরে ছিলো বিদ্যালয়। সবুজ পত্র-পল্লবের ছায়াঘেরা মেঠোপথের সমস্ত ধুলোবালি উড়িয়ে চপ্পল পরে বইখাতাগুলি হাতে নিয়ে স্কুলে যেতাম। তখনো আমাদের গ্রামের স্কুলে স্কুলব্যাগের ব্যবহার হয়ে উঠেনি। তবে দু একজন ছাত্র পলিথিন সপিং ব্যাগে করে বই নিয়ে আসতো শ্রেণিকক্ষে। সেই প্রথম দেখেছি পলিথিন ব্যাগ। তাও সবাই ব্যবহার করতে পারতোনা। যে সব ছাত্রের পরিবার অপেক্ষাকৃত ধনী শুধু তারাই এ ব্যাগ ব্যবহার করতো। প্রতিটি পলিথিন ব্যাগ ছিলো এক টাকা করে। হরেক রংয়ের ব্যাগ পাওয়া যেতো। বিশেষ করে লাল-নীল, সবুজ হলুদ। সেই প্রথম স্বুলে পলিথিনের ব্যগ দেখে চমকে উঠলাম। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে সবাই পলিথিন ব্যাগে করে বই নিয়ে আসতো। বৃষ্টিতে বই ভিজতোনা। তখন অপার বিস্ময়ে পলিথিন ব্যাগের দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম এই পলিথিন হয়তো একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে।

আমাদের শৈশবে বাজারের ব্যাগ ছিলো আলাদা। পাটের তৈরি। বাজার করার সময় সকলেই বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতো। অপেক্ষাকৃত ধনী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারে ব্যাগের পাশাপাশি বাজার করার জন্য বেতের তৈরি ঝুঁড়ি ব্যবহার করতো। আমরা এটিকে গ্রামের ভাষায় খলুই বলতাম। বিশেষ করে তরি-তরকারি, মাছ-মাংস, চাল-ডাল কেনার সময় পরিবহনের সুবিধার্থে অবশ্যই ব্যাগ নিয়ে যেতে হতো। শুধুমাত্র মুদি দোকানে বিভিন্ন মাপের কাগজের থলে ব্যবহার করতো যা ফ্রি দিতো। তথন দেখতাম টাকাওয়ালারা বাজারে আসার সময় ব্যাগ বা খলুই হাতে করে আনতোনা। তারা প্রতিটি এক টাকা করে পলিথিন ব্যাগ কিনে সদাইপাতি বাজার থেকে নিয়ে বাড়ি যেতো।

আমাদের ছোটবেলায় বিশেষ করে একটু অবস্থাসম্পন্ন ঘরে পড়ার টেবিলের প্রচলন ছিলো। তাও সবার জন্য আলাদা আলাদা নয়। এক ঘরে যদি ৩/৪ জন পড়ুয়া থাকে সবার জন্য একটি টেবিল থাকতো। টেবিলের তিনকোনে তিনজন বসতো আর এক পাশে মাষ্টার মশাই বসতো। বেশির ভাগ পরিবারে মাষ্টার মশাই হতো পরিবারের বাবা/মা অথবা বড় ভাইবোন। বিশেষ করে ধনাঢ্য পরিবারে লজিং মাষ্টার রাখার নিয়ম চালু ছিলো। মাষ্টার মশাই রোজ দুবেলা করে ছাত্রদের পড়াতো। বিনিময়ে খাওয়া-থাকার সুযোগ পেতো। তখন দেখেছি ধনী ছাত্রদের পড়ার টেবিলের উপর কাগজ বিছিয়ে উপরে একটি স্বচ্ছ মনোরম প্লাস্টিক কাভার দিয়ে ঢেকে দিতো। প্লাস্টিকের নীচে ক্লাশ রুটিন, প্রয়োজনীয় গাণিতিক সুত্রাবলী ও কিছু কলাকৗশল ও নির্দেশনা সম্বলিত কাগজ রেখে দিতো। যা প্লাস্টিকের উপর দিয়ে পড়া যেতো।

আমার শৈশব কেটে ছিলো শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজ এক গ্রামে। থুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘরের দাওয়ায় রাখা একটি নারিকেলের মালায় কিছু কয়লা বা ছাই থাকতো। ছোট একটি কয়লা মুখে নিয়ে দাঁত মেজে হাত-মুখ ধুয়ে কাজে প্রবেশ করতাম। কেউ কেউ আবার আম ও নিম গাছের পাতা, ডালের মেছওয়াক ব্যবহার করতো। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন সাদা ও কালো রংয়ের মাজন ব্যবহার করতো। বিশেষ করে এদেশে প্লাস্টিকের প্রচলনের সাথে সাথে বাজারে ভরে গিয়েছে নানান রঙ-বেরঙয়ের টুধ ব্রাশ ও টুথ পেষ্ট। যাদের কেনার সামর্থ্য ছিলো তারা বিশেষ করে টুথ ব্রাশ ও পেষ্ট ব্যবহার করতো। সেই থেকে যে আমরা প্লাস্টিক মুখে তোলা শিখেছি আর মুখ খেকেতো নামাতে পারিনি তবে মন-প্রাণ থেকেও এই জন-জীবনকে বিষাক্ত করে তোলা ও পরিবেশের হুমকি এ্ই পলিথিন প্লাস্টিককে সরাতে পারিনি। এখন আমরা খাবার খাওয়া , চা পান হতে শুরু করে জীবন-ধারণের চালচিত্রের সবকিছুতে প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।

আমাদের ছোটবেলায় দেথতাম বিশেষ করে ফসলের বীজ রাখার কনটেইনার ও পানি রাখা এবং রান্নার পাত্র হিসেবে মাটির পাত্র ব্যবহার খুব বেশি ছিলো। চাল, ডাল, সরিষাসহ সকল ফসলের বীজ রাখা হতো মাটির মটকায়। পানির কলস, বদনা, গ্লাস, প্লেট, রান্নার হাড়ি-পাতিল, বাটি, চায়ের কাপ, মাটির ব্যাংক অনেক কিছুই মাটির তৈরি ছিল, কুমাররা মৃৎশিল্প নিয়ে কাজ করতো। বানাতো মাটির সব নানা কারুকাজ খচিত মাটির পাত্র। আমাদের গ্রামের বাড়ির টয়লেট গুলিতেও মাটির বদনা বা কর্তির ব্যবহার ছিলো। সেই ছোটবেলায় বাংলাদেশে পলিথিন প্লাস্টিকের প্রথম আবির্ভাবের যুগে একদিন টয়লেটে গিয়ে দেখি মাটির পাত্র খানা আর নেই সেখানে স্থান পেলো একটি লাল রংয়ের সুন্দর বদনা। প্রথম প্রথম ব্যবহারে একটু সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে। খুব সন্তর্পনে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক আমাদের মাটির পাত্রগুলোকে ধ্বংস করে সবকিছুতে প্লাস্টিক এর হযে গেলো। আমরা যেখানে-সেখানে ধনী-দরিদ্র বলে কথা নেই সকল পরিবারে দেখতে পাই প্লাস্টিকের কনটেইনার, বদনা, গ্লাস, ঢাকনা, ব্যাংক সব প্লাস্টিক জয় করে নিলো। আমাদের দেশ থেকে মৃৎশিল্প হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। হারিয়ে গেলো আমাদের মাটির কারুকাজখচিত মনোরম পাত্রগুলি।

সেই আশির দশকে পলিথিন ও প্লাস্টিক আবিস্কার আমাদের চোখে ছিলো এক ধরণের বিস্ময়। তবে প্রতিটি সামগ্রী আবির্ভাব বা আবিস্কারের রয়েছে কিছু সুফল ও কুফল। পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও সংবাদ পত্রে , ম্যাগাজিনে কিংবা চায়ের স্টলে, পাড়ার আড্ডায় আলোচনা সমালোচনার অন্ত ছিলোনা। সমাজ সংস্কারক ও নীতি-নির্ধারকরাও এর সুফল ও কুফল নিয়ে প্রচুর মিছিল মিটিং সেমিনার কনফারেন্সও করেছে। তবুও সবকিছুকে ছাপিয়ে পিছনে ফেলে আজ পলিথিন/ প্লাস্টিকেরই জয়-জয়কার। এখন আমরা সবকিছুতেই বলতে আমাদের জীবন-ধারণ ও চালচিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পলিথিন/প্লাস্টিকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। এখন স্কুল ব্যাগ হিসেবে যদিও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার না হলেও ছাত্রদের বিভিন্ন উপকরণ যেমন, কলম, খাতার কাভার, পেনসিল, জ্যামিতির বাক্স অনেক ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। বাজারে যাওয়ার সময় এখন ধনী/দরিদ্র কেউ আর বাজারের ব্যাগ বা খলুই নিয়ে যায়না। দোকানদাররা পলিথিন/প্লাস্টিকের ব্যাগ ফ্রি দেয়। এখন প্লাস্টিকের এমন যুগান্তকারী ব্যবহার বেড়েছে আমাদের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সবই এখন প্লাস্টিকের তৈরি। এমন কি গাড়ি. মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টসহ সকল যন্ত্রাংশেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি বিদ্যমান।

এই পলিথিন প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে আমাদের সোনার বাংলার সোনালী আঁশ পাটের তৈরি বাজারের ব্যাগ এখন আর কেউ ব্যবহার করেনা। ধ্বংস হয়ে গেছে বাংলার অর্থকরী ফসল পাটের বাজার। হারিয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় আদমজী জুটমিল। পরিবেশ বিধ্বংসী এই পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার জন্য এখন আর কেউ সোচ্চার হয়না, আওয়াজ তুলেনা। এমনকি সভা-সমাবেশ মিছিল মিটিং কিছুই হয়না। সবাই যার যার জায়গায় নিরবতা পালন করে।

এই পলিথিন প্লাস্টিকের মাত্রাতিরিক্ত ও যত্রোতত্রো ব্যবহারের ফলে নগরীর নালা-নর্দমা, ড্রেন-খালগুলিতে পানি নিস্কাসনে অসুবিধা হচ্ছে। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় ঢাকা ও চট্রগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলির রাস্তা-ঘাট ফুলেফেঁপে নদী বা সাগরে রুপান্তরিত হয়। জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এখন আগের মতো জমিতে ফসল জম্মেনা। আমাদের খাবার দাবারের সাথেও পলিথিন/প্লাষ্টিকের বিষক্রিয়া মিশে বিভিন্ন রোগ-বিরোগের শিকার হচ্ছি। আমরা একদিকে স্বস্তায় পলিথিন স্বামগ্রীকে জীবনে জড়াচ্ছি আর অন্যদিকে পৃথিবীকে করছি ক্রমান্বয়ে বিষাক্ত এবং পলিথিনের পাশ্ব-প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশকে করছি দূষিত, ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হচ্ছি এবং হাজার হাজার টাকা ব্যয় করছি এর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায়। তবুও পলিথিন আমাদের পথের পাথেয় এবং জীবনের পরম সম্পদ। পলিথিন/প্লাস্টিক ছাড়া বাঁচা ভীষণ মুশকিল।

আমাদের সুন্দর ধরিত্রী বা পরিবেশকে মানবগোষ্ঠির বসবাসের যোগ্য ও উপযুক্ত করে তুলতে হলে প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত বা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার করতে হবে। আবহমান বাংলার প্রাচীন কৃষ্টি-কালচার ও চালচিত্র সংরক্ষণ করতে হলে পলিথিনকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের বাজার ফিরে পেতে হলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠকারী পলিথিন প্লাস্টিককে ঝেঁটে বিদায় করতে হবে। আমাদের ঐতিহ্যবাহি মৃৎশিল্প কুমার পেশাকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাটির পাত্রের ব্যবহার চালু করতে হবে।

আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ জম্মে। আমরা এই বাঁশ দিয়েও ব্রাশ তৈরি করে প্লাস্টিককে সকাল বেলায় মুখে তোলা থেকে বিরত থাকতে পারি। আমাদের স্বাস্থ্য সুন্দর ও সুস্থ্য রাথতেও পলিথিন একটি বড়ো অন্তরায়। দেশ ও দেশের মানুষকে নিরাপদ ও সুস্থ্য-সামর্থবান রাখতে হলে আমাদের সকল কে একযোগে পলিথিন-প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে “না” বলতে হবে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অধিপরামর্শ করতে হবে এবং আইন-কানুন ও নীতিমালা তৈরি করতে দেশের সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য-সামগ্রির বহুবিধ ব্যবহার করতে হবে।

আমাদেরকে আমাদের সুন্দর এই পৃথিবী নিরাপদ ও সবুজ করতে সমাজের সকলকে সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি আমাদের জীবন-ধারণ ও চালচিত্রে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আমরা আমাদের লাইফ-স্টাইল না বদলালে কখনো আমরা জীবন থেকে একেবারে পলিথিন/প্লাস্টিককে বিদায় করতে পারবোনা।

ম্যাকি ওয়াদুদ: সমাজ কর্মী ও লেখক এবং প্রাবন্ধিক

Print Friendly

Related Posts