চলে গেলেন কথাশিল্পী রশীদ হায়দার

মঙ্গলবার সকালে ছোট মেয়ে শাওন্তি হায়দারের বাসায় এই লেখকের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক শাওন্তির স্বামী ইশতিয়াক আজাদ বলেন, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন তার শ্বশুর।

“গত ফেব্রুয়ারি মাসে উনার স্ট্রোক করেছিল। এরপর থেকে আর হাঁটাচলা করতে পারতেন না।”

রশীদ হায়দার ১৯৪১ সালের ১৫ জুলাই পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম শেখ ফয়সাল আবদুর রশীদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন হায়দার,ডাকনাম দুলাল।

১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তখনকার জনপ্রিয় সিনে ম্যাগাজিন চিত্রালীতে কাজ শুরু করেন রশীদ হায়দার।

১৯৬৪ সালে চিত্রালীর পাশাপাশি তিনি পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড এর মুখপত্র পরিক্রম পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান।

এক সময় চিত্রালীর কাজ ছেড়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দেন ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে চাকরি নেন রশীদ হায়দার। ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে তিনি অবসরে যান। পরে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলা একাডেমিতে থাকাকালে রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষের স্মৃতিচারণা নিয়ে গ্রন্থ ‘স্মৃতি: ১৯৭১’, যাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘দালিলিক গ্রন্থ’ হিসেবে বিবেচনা করেন সমালোচকরা।

১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় রশীদ হায়দারের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নানকুর বোধি’। ১৯৭২ সালে দৈনিক সংবাদে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেন নিজের প্রথম উপন্যাস ‘গন্তব্যে’।

অর্ধেক মুদ্রিত হওয়ার পর কোনো এক অজানা কারণে লেখাটি তিনি আর শেষ করতে পারেননি। পরে ১৯৮৬ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আকারে ‘অসম বৃক্ষ’ নামে সেটি প্রকাশিত হয়।

গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, নিবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সম্পাদিত গ্রন্থ মিলিয়ে রশীদ হায়দারের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭০ এর বেশি।

‘খাঁচায়’, ‘অন্ধ কথামালা’, ‘নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য’, ‘নদী ও বাতাসের খেলা’, ‘উত্তরকাল’, ‘পূর্বাপর’, ‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’, ‘বৃহন্নলা ও অন্যান্য গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প’, ‘তিনি একজনই’ তার উল্লেখযোগ্য বই।

আর নাটক নিয়ে তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘নাটক: সেক্সপীয়র দি সেকেন্ড’, ‘তৈল সংকট’, ‘গোলাপ গোলাপ’, কাফকার দ্য ট্রায়ালের নাট্যরূপ-‘কাঠগড়া’।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন, ‘বিবিধ: বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা (জীবনী)’, ‘অসহযোগ আন্দোলন: একাত্তর’, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’, ‘স্মৃতি:৭১ (১৩ খণ্ড)’, ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’, কিশোর উপন্যাস: ‘শোভনের স্বাধীনতা’, ‘যুদ্ধ ও জীবন’ ইত্যাদি।

রশীদ হায়দার কথাশিল্পী হিসেবে মঞ্চে অভিনয়ও করেছেন। ১৯৬৪ সালে মুনীর চৌধুরীর পরিচালনায় তিনি অভিনয় করেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটকের ‘কিংকর’ চরিত্রে।

ছাত্রজীবনের শেষেও প্রায় এক দশক তিনি নাট্যজগতের সাথে জড়িত ছিলেন। ওই সময় তার বড় ভাই জিয়া হায়দার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘মাস্টার অব ফাইন আর্টস’ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ নামে একটি নাট্যদল গঠন করেন। রশীদ হায়দারও অগ্রজের সাথে সেই দলে যুক্ত হন।

দৈনিক বাংলায় কেরোসিন তেল সঙ্কট নিয়ে রশীদ হায়দারের ‘তেল’ নাটকটি পরে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নাট্যরূপ দেয়।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য সরকার ২০১৪ সালে রশীদ হায়দারকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তার আগে ১৯৮৪ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

রশীদ হায়দার ও আনিসা আখতার দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে হেমন্তী হায়দার হেমা। আর ছোট মেয়ে শাওন্তী হায়দার ক্ষমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

Print Friendly

Related Posts