হাজী সেলিমের সব সম্পত্তি একাই দখলের চেষ্টায় ছিলেন ইরফান!

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (বরখাস্ত) ইরফান সেলিমের ক্ষমতার দাপট শুধু বাইরে নয়, পরিবারের মধ্যেও ছিল। সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের পুরো পরিবারের অশান্তির কারণ ছিলেন তিনি। ইরফান দুই ভাইকে বাদ দিয়ে একাই বাবা হাজী সেলিমের সব সম্পত্তি একাই দখলের চেষ্টায় ছিলেন। এর প্রতিবাদ করার কারণে বড় ভাই সোলেমান সেলিমের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেননি তিনি।

সম্পত্তি দখলে ছোট ভাই আশিক সেলিম যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ান এজন্য তাকে কৌশলে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেশে এসে যাতে আশিক ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে এজন্য তাকে অতিরিক্ত টাকা পাঠান। আর বড় ভাই সোলেমান সেলিম অনেকটা ইরফানের কাছে জিম্মি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, ২০১৮ সালের জুন মাসে ইরফান তার বাবাকে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য চাপ দেন। কিন্তু অপর দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি তা করতে রাজি হননি। যে কারণে হাজী সেলিমকে বেশ কিছুদিন বাড়ির বাইরে বের হতে দেননি ইরফান। এতে তিনি সন্তান ইরফানের ওপর আরো ক্ষিপ্ত হন। সন্তানের এমন অপকীর্তির কারণে লোকলজ্জায় হাজী সেলিম বাইরে কাউকে কিছু বলতেও চাননি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইরফান নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে পিটিয়ে ঘটনাস্থল থেকে গাড়ি রেখে পালিয়ে যান। পরে যখন বিষয়টি চাউর হয়ে যায়, তখন নিজে বাঁচার জন্য তাদের প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের কর্মকর্তাকে ধানমণ্ডি থানায় পাঠান, যেন বিষয়টি আপসের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়। যাতে ওই কর্মকর্তা কোনো মামলা না করেন। শুধু থানায় নয়, তারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেন আপসের জন্য। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ধানমণ্ডি থানায় সিগন্যাল যায় যে, ভিকটিম যে পদক্ষেপ নিতে চাইবে সেই পদক্ষেপে যাতে পুলিশ সায় দেয়। অভিযোগ নিতে যেনো পুলিশ গড়িমসি না করে। পুলিশের শক্ত অবস্থান এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কড়া সিগন্যালের কারণে ইরফানের আপসের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ধানমণ্ডি জোনের এডিসি আব্দুল্লাহিল কাফি গণমাধ্যমকে জানান, নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের মারধরের ঘটনায় দু’পক্ষই থানায় এসেছিল। পরে ভিকটিমের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, তিনি মামলা করবেন। পুলিশ তার মামলা নিয়েছে। বিষয়টি পুলিশ সুষ্ঠুভাবে তদারকি করেছে।

বাসা বা অফিস থেকে যখন তিনি বের হতেন তখন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীরা এবং প্রাইভেট বাহিনীর সদস্যরা গাড়ির হুইসেল বাজিয়ে পুরো রাস্তা ফাঁকা করতেন

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, হাজী সেলিম অসুস্থ হওয়ার আগে পুরো ব্যবসার ভার তিনি একাই সামলাতেন। যখন তিনি স্ট্রোক করে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তখনই মদিনা গ্রুপের পুরো ব্যবসা নিজে কব্জা করার চেষ্টা করেন ইরফান। তার এই অপকর্মে দুই ভাই ছিলেন বড় অসহায়। অনেকটা বাধ্য হয়ে সোলেমান সেলিম চুপ হয়ে যান। মদিনা গ্রুপের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তার দ্বারা মানসিক নির্যাতনের কারণে একাধিক কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

পুলিশ জানায়, বাসা বা অফিস থেকে যখন তিনি বের হতেন তখন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীরা এবং প্রাইভেট বাহিনীর সদস্যরা গাড়ির হুইসেল বাজিয়ে পুরো রাস্তা ফাঁকা করতেন। হুইসেল শোনার পর যদি কারো গাড়ি রাস্তা থেকে দ্রুত না সরতো তাহলে তাদের কপালে তাৎক্ষণিক শনির দশা নেমে আসতো। তার প্রাইভেট বাহিনী তাকে সেখানেই পিটিয়ে জখম করে দিতো। ঘটনাস্থলে পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ বিষয়গুলো দেখেও না দেখার ভান করতো।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন গভীর রাতে মদ পান করে ইরফান তার ক্যাডার বাহিনীকে নিয়ে চকবাজার এলাকায় হাঁটতে বের হতেন। রাতে ব্যক্তিগত কাজে কেউ বের হলে তিনি তাদের অযথা জেরা করতেন। কোনো ধরনের তর্কে জড়ালেই তাকে ধরে নিয়ে যেতেন টর্চার সেলে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিল হলেও সাধারণ মানুষ তার কাছে সমস্যা নিয়ে গেলে তাকে পেতো না। তার বডিগার্ড জাহিদ অঘোষিত কাউন্সিলর ছিলেন। এলাকার সব বিষয়াদি তিনি দেখভাল করতেন।

বাবার প্রভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও হয়েছেন তিনি। বিয়ে করেছেন নোয়াখালীর সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর মেয়েকে। মদিনা গ্রুপের একজন কর্মকর্তা জানান, কানাডায় ব্যবসা প্রশাসনে লেখাপড়া করে সাত বছর আগে দেশে ফেরেন ইরফান সেলিম। তবে গত ফেব্রুয়ারির সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেই বাইরে তার আনাগোনা ধরা পড়ে এলাকার মানুষদের চোখে।

বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে আসার পরও এলাকায় ইরফানকে তেমন দেখা যেত না। কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় প্রচারণায় ও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এলাকায় তাকে দেখা যেত, বলেন স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী।

পুলিশ জানায়, রবিবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যার দিকে সস্ত্রীক মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খান। সেসময় একটি গাড়ির সঙ্গে তার মোটরসাইকেলটির ধাক্কা লাগার পর গাড়িটি থেকে অভিযুক্তরা নেমে এসে তাকে মারধর করে। নিজের পরিচয় দেয়ার পর তাকে মারধর অব্যাহত রাখে।

পরে সোমবার পুরনো ঢাকায় ইরফান সেলিমের বাড়িতে ছয় ঘণ্টা ধরে অভিযান চালায় পুলিশ। সেসময় বিদেশি মদ রাখার অপরাধে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষীকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

র‌্যাব সূত্র জানায়, সোমবার দুপুরে গ্রেফতারের সময় ইরফান মদ্যপ অবস্থায় ছিল। রাত সাড়ে ১২টায় র‌্যাব-৩ থেকে কারাগারে পাঠানোর আগ পর্যন্ত নেশাগ্রস্থ ছিলেন তিনি।

রোববার রাত থেকে অভিযানের আগ পর্যন্ত পান করেছেন আড়াই বোতল বিদেশী মদ। স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে একসঙ্গে এতো মদপান করেছেন বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের অভিযানকালে চকবাজারের রাজসিক প্রাসাদ ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ী’র চতুর্থ তলায় অবস্থান করছিলেন ইরফান। আর তার স্ত্রী (নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরাম চৌধুরীর মেয়ে) তখন ভবনের তৃতীয় তলায় ছিলেন।

সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ৯ তলা এ বাড়িতে অভিযানে ঢুকেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট, র‌্যাব-৩ ও র‌্যাব-১০ এর সদস্যরা। ওই সময় হাজী সেলিমের ওই পুত্র মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তিনি গ্রেফতার করতে যাওয়া র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন।

অভিযানে অংশগ্রহণকারী এক র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, ৪তলার ইরফানের কক্ষটি ভেতর থেকে লক করা ছিল। বাড়ির কেয়ারটেকারকে সঙ্গে নিয়ে সেই রুমে যান অভিযানকারীরা। কেয়ারটেকারের ডাকে দরজা খুলেন ইরফান। এসময় তিনি ঢলতে ছিলেন।  র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তাদের দেখে ইরফান বলতে থাকেন- হু আর ইউ? অ্যাম আই এ ক্রিমিনাল? উইল ইউ অ্যারেস্ট মি?।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, র‌্যাবের অভিযানের আগেই বাড়ির আশপাশের মোড়ে মোড়ে ইরফান সেলিমের লোক দাঁড়ানো ছিল।

র‌্যাবের ধারণা, ওয়াকিটকি দিয়ে পুরো এলাকা নজরদারি করছিল। ওই বাড়ি থেকে একটি ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক স্টেশন উদ্ধার করা হয়েছে।  যেখান থেকে ৩৮টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি পাওয়া গেছে।  যেগুলো সাধারণত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করেন।
এ রুমের একপাশে থাকতেন হাজী সেলিমের ছেলে এরফান সেলিম। পাশের আরেকটি রুমে থরে থরে সাজানো আরও নানা ডিভাইস আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহৃত ওয়াকিটকি আর ড্রোন ক্যামেরাসহ নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

এমনকি মিলেছে হ্যান্ডকাপও। তৃতীয় রুমের বিছানার ম্যাট্রেস উঠানোর পরই দেখা যায় গুলিভর্তি একটি বিদেশী অবৈধ পিস্তল আর বিভিন্ন পরিচয়পত্র। আছে দেশী-বিদেশী নানা ব্রান্ডের মাদকদ্রব্যও।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরফান সেলিমের ৪তলার বেডরুমে একটি মদের খোলা বোতল এবং একটি বক্সে আরও বেশ কয়েকটি বিদেশী মদের বোতল পাওয়া গেছে।  তাকে মদ্যপ অবস্থায় আটক করা হয়।

নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর উপর হামলার অভিযোগে মামলা দায়েরসহ একাধিক কারণ উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরের পদ থেকে ইরফান সেলিমকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়।

ফৌজদারি মামলা ছাড়াও প্রজ্ঞাপনে তাকে বরখাস্ত করার যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: বিদেশি মদ পানের কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অবৈধ ওয়াকিটকি রাখা ও ব্যবহারের দায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া এবং অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার আরো কিছু মামলা দায়েরের কার্যক্রম চলমান থাকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের কোন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন-জনিত অপরাধ ও অসদাচরণের অভিযোগ পেলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার আইন থাকায় সে অনুযায়ী এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর আগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, মামলার কারণে ইরফান সেলিমকে কাউন্সিলরের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

Print Friendly

Related Posts