৩ বিদেশির টাকা হাতানোর কঠিন ফাঁদ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ মো. জিয়া বেসরকারি ব্যাংকের রাজধানীতে একটি শাখার প্রধান হিসেবে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিল দিনকাল। একদিন রোজারস নামের এক বিদেশি নাগরিক জিয়াকে ফোন করে জানান, জার্মানি থেকে তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এসেছেন, একজন ভালো ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তার দরকার। নিজের শাখার মাধ্যমে সেই টাকা লেনদেন হলে সুনাম বাড়বে, সেই আশায় সাহায্য করতে রাজি হন জিয়া।

এর পর থেকেই তিন বিদেশি নাগরিকের সখ্য গড়ে ওঠে জিয়ার। ব্যবসার বিষয় নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে তাঁরা বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে একবার অল্প করে এক বিদেশিকে ধারও দেন। কিন্তু একদিন সেই তিন বিদেশিই প্রতারণা করে তাঁর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন আড়াই কোটি টাকা। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেশ জিয়া র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‍্যাব) জানান।

র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাদের তিনজনকে আটক করে। তাঁরা হলেন কোয়াতি ফসতো, এমিলি ও মাবিদা একিনি। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দেন র‍্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ।

র‍্যাব কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে বেশ কিছু বৈধ ও অবৈধ বিদেশি নাগরিক মাদক ও মুদ্রা পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করছে। এর আগে র‍্যাব দুই শতাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে।

এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে বৃহস্পতিবার মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র‍্যাব। দুপুরে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকায় হাবিবুল আলমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক লিমিটেডের (আইএসএন) কার্যালয় থেকে তাঁকে নিয়ে যান র‍্যাব-১-এর সদস্যরা। হাবিবুল আলম ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানায় র‍্যাব।

র‍্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার মুফতি মাহমুদ জানান, প্রতারকদের টার্গেটে থাকেন বড় বড় ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। বিশেষত বিভিন্ন ধরনের মেলায়, যেখানে এ ধরনের মানুষদের আনাগোনা বেশি, সেখানেই যাতায়াত করেন প্রতারকরা।

গত মাসে ব্যাংকার মো. জিয়াকে রোজারস নামের এক বিদেশি নাগরিক ফোন করে বলেন, তিনি জার্মানিতে থাকেন। বাংলাদেশে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এ জন্য একজন ভালো ব্যাংকার প্রয়োজন।

নিজের সুনাম আর ব্যাংকের ভালোর কথা চিন্তা করে বিদেশিদের সাহায্য করতে রাজি হন জিয়া। এর পর রোজারসের মাধ্যমে আরো তিন বিদেশির সঙ্গে গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে প্রথম বৈঠক করেন জিয়া। এরপর অন্য হোটেলে আরো দুই-তিনবার তাদের মধ্যে বৈঠক হয়।

পরিচয়ের সপ্তাহ দুয়েক পড়ে ওই তিন বিদেশি হঠাৎ করেই একদিন জিয়াকে বলেন, তাদের মধ্যে একজন ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন, তাই দ্রুত কিছু টাকার দরকার। এ জন্য জিয়ার কাছে চার হাজার ডলার ঋণ চায় তাঁরা। জিয়া সরলভাবে তাদের চার হাজার ডলারের ব্যবস্থা করে দেন। সম্পর্ক অটুট থাকে তাদের মধ্যে।

এরপর গত ২০ অক্টোবর তিন বিদেশি জিয়াকে জানান, তাঁরা বাংলাদেশে ১১ হাজার বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করবেন আর পুরো লেনদেনটাই করতে চান তাঁর শাখার মাধ্যমে। কিন্তু তাৎক্ষণিক তাঁদের আড়াই লাখ ইউরো দরকার।

তিন বিদেশি জিয়াকে আরো জানান, তাঁদের কাছে ডলার আছে, সেটাকে ইউরো করতে হবে। তিনি যদি আড়াই লাখ ইউরো জোগাড় করে দিতে পারেন, তবে তাঁকে সমপরিমাণ ডলার দিয়ে দেবেন তাঁরা। সঙ্গে বাড়তি ২০ লাখ টাকাও দেবে। ফাঁদে পড়ে যান জিয়া; অনেক কষ্ট করে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আড়াই লাখ ইউরো জোগাড় করেন।
ডলার-ইউরো লেনদেনের জন্য তিন বিদেশিকে জিয়া নিজের কার্যালয়ে ডাকলেও তাঁরা আসেননি। জিয়ার মোহাম্মদপুরের বাসায় লেনদেনের কথা জানান তাঁরা। একদিন রাতে তিন বিদেশি জিয়ার বাসায় যান। জিয়া তাঁদের ইউরোগুলো দেখান। কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎ বিদেশিদের কাছে থাকা একটি কাচের বোতল নিচে ফেলে দেন একজন। তখন ঘরের মধ্যে সামান্য ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। জিয়া ঘরের পরিবেশ ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এই সুযোগে আড়াই লাখ ইউরো খাম থেকে বের করে নিয়ে সেখানে সাদা কাগজ রেখে দেন বিদেশিরা। এ ঘটনার পর তাঁরা লেনদেন না করেই বেরিয়ে যান। এর পর থেকেই ফোন বন্ধ রাখেন তিন বিদেশি। সন্দেহ হলে জিয়া খাম খুলে দেখেন, সেখানে কোনো ইউরো নেই, সবই সাদা কাগজ। আর তখনই তিনি বুঝতে পারেন, আসলে প্রতারণা শিকার হয়েছেন। তারপরই তিনি বিষয়টি র‍্যাবকে জানান।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts