স্ট্রোক : চিকিৎসা ও প্রতিরোধে প্রতিকার

অধ্যাপক ডাঃ এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী

কাউকে যদি কল্পনা করতে বলা হয় তার এক হাত, এক পা এবং মুখের এক পাশ ব্যবহার না করে দিনের স্বাভাবিক কাজ গুলো করার চেষ্টা করতে, তাহলে তার পক্ষে কিছুটা অনুভব করা সম্ভব যে একজন স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর জীবন কতটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যায়।

স্ট্রোক মস্তিষ্কেও একটি মারাত্মক রোগ যার ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে জটিলতা দেখা দেয় এবং হঠাৎ করেই মস্তিষ্কের একাং শকার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্কের কোষ অত্যন্ত সংবেদনশীল। অক্সিজেন ও শর্করা সরবরাহে একটু হেরফেরে কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। যদি মস্তিষ্কের কোনো অংশের রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয় (আঘাত জনিত কারণ ছাড়া) এবং তা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয় অথবা ২৪ ঘন্টার মধ্যে রোগী মৃত্যবরণ করে, তাহলে এ অবস্থারনাম স্ট্রোক।

স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস (পক্ষাঘাত) এর মতো মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়, কিছু স্ট্রোকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। স্ট্রোক হলে শরীরের যে কোনো একদিকে হাত-পা ও মুখমন্ডল প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। ব্রেইনের ভেতর স্ট্রোকটা যদি বাঁ দিকে হয়, তাহলে ডান দিকের হাত-পা এবং ডানদিকে স্ট্রোক হলে বাঁ দিকের হাত-পা প্যারালাইসিস হয়ে থাকবে।

মোটকথা, ব্রেইনের যে যে অংশ শরীরের যে যে অংশ নিয়ন্ত্রণকরে, সেই সেই অংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে শরীরের ওই স্থানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। স্ট্রোকের ধরণ ও পরিমাপ অনুযায়ী প্যারালাইসিসের ধরণ ও পরিমাপ নির্ভরকরে।

আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে স্ট্রোক এবং হার্ট এটাক একই রোগ। মনেরাখতে হবে স্ট্রোক হার্টের কোন রোগনয়, মস্তিষ্কের রোগ। হার্টের রোগের চিকিৎসার জন্য যেমন হাসপাতালে নির্দিষ্ট বিভাগ এবং ডাক্তার থাকেন, স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্যও আলাদা বিভাগ এবং ডাক্তার আছেন। স্ট্রোকের লক্ষণ চিনে রোগীকে দ্রুত নির্দিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

স্ট্রোকের লক্ষণ:

স্ট্রোকের লক্ষণ হলো হঠাৎ করে শরীরের একাংশ অবশবা দুর্বল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা ও বমিহওয়া, হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া অথবা কথা জড়িয়ে যাওয়া, বা একেবারেই কথা বলতে না পারা। স্ট্রোক হলে মাথা ঝিমঝিম করে, প্রচন্ড মাথাব্যথার সঙ্গে ঘাড়, মুখ ও দুই চোখের মাঝ খান পর্যন্ত ব্যথা হয়। হাঁটতে বা চলাফেরা করতে এবং শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হয়। কথাবার্তা জড়িয়ে যায়, অস্পষ্ট শোনায়। শরীরের এক পাশ দুর্বল, অসাড় কিংবা দৃশ্য দুটি দেখা, বমিবমি ভাব বা বমি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। স্ট্রোকের লক্ষণ মনে রাখার জন্য FAST শব্দটি মনে রাখতে হবে।

F – Face (মুখমন্ডল): মুখের একদিক বাঁকা হয়ে যাওয়া।
A – Arm (হাত): এক হাত দূর্বল হয়ে পড়া।
S – Speech (কথা): কথা জড়িয়ে আসা।
T – Time (সময়): যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসা।

হঠাৎ কারও এই লক্ষণগুলো দেখা গেলে বুঝতে হবে যে তার স্ট্রোক হয়েছে। এক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে সময় নষ্ট না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে স্ট্রোকের রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

স্ট্রোকের প্রকারভেদ:

মস্তিষ্ক আক্রান্ত হওয়ার ধরণের উপর ভিত্তি করে স্ট্রোক দুই প্রকারের হতে পারে।

ইস্কেমিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে, অথবা শরীরের কোন অংশ বিশেষ কওে হৃদপিন্ড থেকে জমাটবাধা রক্ত মস্তিষ্কের রক্তনালিতে এসে রক্তপ্রবাহ বন্ধহয়ে যে স্ট্রোক হয় তা ইস্কেমিক স্ট্রোক নাম পরিচিত। এধরণের স্ট্রোকআক্রান্ত রোগীর মৃত্যু আশঙ্কা কম থাকলেও ভালো হতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং অনেক রোগী স্থায়ী পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকেন।

হেমোরেজিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের কোন রক্তনালী ফেটেগিয়ে মস্তিষ্কের ভেতর রক্ত ছড়িয়ে পড়লে তাকে হেমোরয়েজিক স্ট্রোক বলে। এধরণের স্ট্রোকে লক্ষণ উপসর্গ নির্ভরকরে ব্রেইনের কোন অংশ কিভাবে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারওপর। অনেকক্ষেত্রেই রোগীর উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং রোগীঅজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। এই স্ট্রোকে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। যারা প্রাথমিক ধকলকাটিয়ে উঠতে পারেন, দ্বিতীয়বার রক্তক্ষরণের ঝুঁকি তাদের কম থাকে, এবং তাদের প্যারালাইসিস অপেক্ষাকৃত কম সময়েভালো হয়। স্থায়ী পঙ্গুত্বের সম্ভাবনাও কম।

স্ট্রোকের চিকিৎসা:
যে ধরণের স্ট্রোকই হোকনা কেন, ভালো বা মন্দ হওয়া নির্ভর করে প্রাথমিক মেডিকেল ও পুনর্বাসনচিকিৎসা কতটা দ্রুত, কার্যকর ও সার্থকভাবে দেওয়া হয়েছে তারও পর।

স্ট্রোকের ধরণ ও প্রকারভেদ অনুসারে স্ট্রোকের চিকিৎসা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল স্ট্রোকের লক্ষণ খেয়ালকরে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসা। স্ট্রোক চিকিৎসার প্রধান অংশ হলো নার্সিং এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও পরিমিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ইসকেমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রোগীকে যদি ৩-৪ ঘন্টারমধ্যে হাসপাতালে নিয়ে আসাযায় তাহলে থ্রম্বোলাইসিস (ইনজেকশনের মাধ্যমে জমাটবদ্ধ রক্ত গলিয়ে ফেলা) এবং থ্রমবেকটমি (স্টেন্ট এরমাধ্যমে জমাটবদ্ধ রক্ত বেরকরে নিয়েআসা) এরমাধ্যমে কিছু রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব। অন্যান্য ক্ষেত্রে চিকৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যবস্থাপত্র দেবেন অথবা ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেবেন।

হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি সার্জারি, সার্জিকাল ক্লিপিং, অথবা কয়েলিং এর মাধ্যমে চিকিৎসাকরা সম্ভব। তবে স্ট্রোকের চিকিৎসা সম্পূর্ণ নির্ভরকরে রোগীর অবস্থা, স্ট্রোকের ধরণএবং রোগী কত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছেছে তার ওপর।

এছাড়া কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। যেমন – শ্বাস নিতে সমস্যা হলে কিংবা শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে। বমি হলে মাথা একদিকে কাত কওে দিতে হবে। অন্যদের মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো খাবার বা পানি খাওয়ানো যাবেনা। অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে শ্বাসনালী, শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন নিয়মিত রাখতে হবে। রোগীকে একদিকে কাতকরে শোয়াতে হবে। চোখ ও মূত্র থলির যত্ন নিতে হবে, প্রয়োজনে ক্যাথেটার ব্যবহার করতেহবে। রোগীর সঙ্গে কমপক্ষে দুইজন ব্যক্তিকে হাসপাতালে যেতে হবে। এর ফলে পরীক্ষা ও চিকিৎসা সবকিছুই কিছুটা দ্রুত গতিতে করা সম্ভব হবে।

স্ট্রোকের কারণ:

বাংলাদেশে স্ট্রোকের হার প্রতি হাজারে ৫ থেকে ১২ জন। প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ স্ট্রোকের ঝুঁকির মধ্যে আছে। সাধারণত যাদের বয়স ৫৫ বছরের বেশি, তাদের স্ট্রোক হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। পুরুষ দেরমধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বেশি। এছাড়া উচ্চরক্তচাপ, বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস, হৃদরোগী, অতিরিক্ত মোটা ব্যক্তিরা স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। পরিবারে কারও স্ট্রোক বা হার্ট এটাক হওয়ার ইতিহাস থাকলে, ধূমপান বা এলকোহোল জনিতসমস্যা থাকলে, হৃদপিন্ডের অসুখ যেমন- নাড়ির অস্বাভাবিক স্পন্দন, হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, হৃদপিন্ডের সংক্রমণ থাকলে, কোন হরমোন থেরাপি অথবা জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবন করা, আগে এক বা একাধিক স্ট্রোক অথবা টিআইএ হয়ে থাকলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

প্রতি রোধের উপায়:

স্ট্রোক অনেকাংশেই প্রতিরোধ যোগ্য। স্ট্রোক এর প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। এজন্য স্ট্রোকের ঝুঁকি সম্পর্কে জানা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলাউচিত। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি হলো নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখা। অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার না খাওয়া এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা।সঠিক নিয়মে সময়মতো এবং সঠিক পরিমানে খাবার খাওয়া। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম করা বা সময় করে হাঁটা, সম্ভব হলে হালকা দৌড়ানো। শরীর যেন মুটিয়ে না যায় অর্থাৎ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। শাকসবজি, ছোটমাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি মাছ, দুধ, ভুষি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।

স্ট্রোক থেকে প্যারালাইসিস, কোমা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। সামান্য সচেতনতার মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে ৫০ শতাংশ রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। এছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

অধ্যাপক ডাঃ এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী
অধ্যাপক ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল
চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটাল
বাড়ি-১, রোড-৪, ধানমন্ডি, ঢাকা।
০১৮৬৫৪৪৪৩৮৬, ০১৮৬৫৪৪৪৩৮৫

Print Friendly

Related Posts