শামসুন্নাহার রহমান পরাণ স্মৃতি পদক পাচ্ছেন তিন নারী

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সমাজে বিভিন্ন সেক্টরে অনবদ্য অবদানের জন্য এ বছর তিনজন পচ্ছেন বেসরকারি সংস্থা ‘ঘাসফুল’ এর প্রতিষ্ঠাতা, মহীয়সী নারী শামসুন্নাহার রহমান পরাণ স্মরণে প্রবর্তীত ‘শামসুন্নাহার রহমান পরাণ স্মৃতি পদক-২০২০’। পদক বিজয়ীরা হচ্ছেন- সমাজসেবায় রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, নৃগোষ্ঠির সফল উদ্যোক্তা মঞ্জুলিকা চাকমা ও তৃণমূলে সফল উদ্যোক্তা মোমেনা বেগম।

আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি বিকাল সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে স্মরণানুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পদক তুলে দেয়া হবে। অনুষ্ঠানে পরান রহমান স্মরণে অনুষ্ঠিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন, বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রাক্তন মুখ্যসচিব ও ব্র্যাকের উপদেষ্টা মো: আবদুল করিম, উন্নয়ন সংস্থা মমতার প্রধান নির্বাহী আলহাজ্ব রফিক আহমদ, অনন্যা কল্যাণ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ডনাই প্রু নেলী, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ এর সম্পাদক রুশো মাহমুদ এবং ঘাসফুল নির্বাহী পরিষদ সদস্য পারভীন মাহমুদ এফসিএ উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন ঘাসফুল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফতাবুর রহমান জাফরী এবং সভাপতিত্ব করবেন ঘাসফুল চেয়ারম্যান ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী।

উল্লেখ্য, পরাণ রহমান ১জুন ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম এনায়েতবাজারস্থ মায়াকুটিরে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং বর্ণাঢ্য এক কর্মজীবন পাড়ি দিয়ে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি এই মহীয়সী নারী মৃত্যু বরণ করেন। ২০১৭ সালে তাঁর ২য় মৃত্যুবার্ষিকীতে ঘাসফুল পরিবার প্রথমবারের মতো ‘শামসুন্নাহার রহমান পরাণ স্মৃতি পদক’ প্রর্বতন করে। সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে বিশেষ অবদানের জন্য গুণীজনদের সম্মানিত করার প্রয়াসে ও উন্নয়ন সংগঠক পরাণ রহমানের স্মৃতি সংরক্ষণে ২০১৭ সালে তিন ক্যাটাগরীতে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য চারজন সফল ব্যক্তিত্বকে ‘শামসুন্নাহার রহমান পরান স্মৃতি পদক’ প্রদান করা হয়। পদকপ্রাপ্তরা ছিলেন; শিক্ষা ও গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো, সমাজসেবায় ‘স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির’ নির্বাহী পরিচালক বেগম রোকেয়া এবং তৃণমূলে সফল নারী (অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী) ক্যাটাগরীতে জান্নাত বেগম ও তৃণমূলে সফল নারী (শিক্ষা) ক্যাটাগরীতে পদক পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুমি আক্তার।

বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে আমৃত্যু কাজ করেছেন ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা শামসুন্নাহার রহমান পরাণ। ১৯৭২ সালে তিনি উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একজন সফল উন্নয়নকর্মী, নারীনেত্রী, সমাজসেবক, লেখক, গল্পকার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতীত বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক। চট্টগ্রামে তিনিই প্রথম তথাকথিত অচ্ছুত সম্প্রদায়; পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। তিনি দেশে গার্মেন্টসশিল্পের গোড়ার দিকে পোষাক কারখানার নারীশ্রমিক এবং উপকূলীয় জেলেদের দক্ষতা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন। বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে এনজিও স্কুলগুলোতে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম সরকারি বইপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি আশির দশকে নগরের নিম্নআয়ের মানুষদের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের মাধ্যমে সফলতার সাথে ট্রেডিশনাল বার্থ এ্যাটেন্টডেন্ট (টিবিএ) কার্যক্রম চালু করেন।

পরাণ রহমান সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং’ এর প্রেসিডেন্ট এবং ‘লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগং পারিজাত এলিট’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’ চট্টগ্রাম ও চিটাগাং ওয়ার্কিং ওমেন কো-অপারেটিভ লিঃ এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কারাগারের কারা-পরিদর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শামসুন্নাহার রহমান পরাণ ১৯৯২ সাল থেকে ‘জাতীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কাউন্সিল’ ও ‘সাউথ এন্ড সেন্ট্রাল এশিয়া রিজিওনাল কনফারেন্স অন এডুকেশন ফর অল’-এর সদস্য।

এছাড়া তিনি ‘ন্যাশনাল টিবি এসোসিয়েশন (নাটাব)’, ফ্যামেলী প্লানিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, রেড ক্রিসেন্ট, রোগী কল্যাণ সমিতি, চিটাগং ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল, অটস্টিক স্টুডেন্ট ডেভলেপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার চিটাগং (এসিডিডব্লিউসি), প্রাক্তন সভাপতি লেখিকা সংঘ, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি ওমেন এর প্রাক্তন সভাপতি ও আজীবন সদস্যসহ সংস্থাগুলোয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রবীণ অধিকার ফোরাম ও এইজিং রিসোর্স সেন্টার, ফোরাম ফর দি রাইট্স অব দি এলডারলি এর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং সাজেদা পল্লী স্বাস্থ্য ও পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্ব দেন। পরাণ রহমান বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান এর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং আজীবন প্রবীণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন।

তিনি একদিকে বঞ্চিত মানুষের জন্য মাঠে-ময়দানে নেমে কাজ করেছেন, অন্যদিকে লেখালেখিতেও ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঘাসফুল জন্মের ৪৩ বছর পেরিয়ে আজ জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কৃষি, তথ্য প্রযুক্তি, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অধিকার ও আইনী সহায়তা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও সুনামের সাথে বাস্তবায়ন করছে। পরাণ রহমানের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ঘাসফুলের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সুনাম ছড়িয়েছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা ঘাসফুলে আসছে উন্নয়ন কর্মকান্ডের ব্যবহারিক শিক্ষা অর্জনে।

Print Friendly

Related Posts