বঙ্গবন্ধুর স্বেচ্ছাশ্রম উৎপাদন গ্রামোন্নয়ন ডাক

এএইচএম নোমান

পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সর্ব প্রথম যে গ্রাম থেকে ‘দেশ গড়ার ডাক’ দিতে গেলেন সে গ্রামের নাম- চর পোড়াগাছা, ইউনিয়ন- চর বাদাম, থানা- রামগতি, জেলা- নোয়াখালী (বর্তমানের লক্ষ্মীপুর জেলা)।

দিনটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ইং। শীতের আমেজ ছিল। মনে আছে ২টি হেলিকপটার যোগে বঙ্গবন্ধু বাগ্যারদোনা স্রোতহীন মেঘনা ঘেষে নুতন গড়ে উঠা চর কলাকোপা, মৌজা চর পোড়াগাছা পৌঁছেন। সকাল ১০টায় হেলিকপটার থেকে বিশাল ব্যক্তিত্ব স্বপ্নমুখী বঙ্গবন্ধু নামতে নামতে চেনামুখ তোফায়েল ভাইসহ আরো অনেকে নেমে এলেন। পুরো নুতন চর জাগা এলাকা জনসমুদ্র। কে কাকে দেখে, সবাইর শ্রদ্ধা ভরা তীর চোখ প্রাণ প্রিয় মুক্তির প্রতিকৃতির দিকে। দৃঢ় পায়ে হেঁটে ডান বাম তাকাতে তাকাতে ১-২ বার খোলা আকাশের দিকে (আল্লাহর শোকরিয়া) তাকিয়ে তৈরী নুতন স্থাপন করা হুগলা/তেরপাল মোড়ান মাটির কিল্লায় যথাস্থানে দাড়ালেন। চতুর্দিক ঘুরে ঘুরে আবাল-বৃদ্ধ-যুব-কিশোর শিশু মানব সমুদ্রের উৎফুল্ল মুহুর্মূহু হর্ষধ্বনির উত্তরে, হাত নেড়ে অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। আমার মত আনাড়ি লেখকের ভাষায় এ সমৃতিময় অভূতপূর্ব ও বিরল মুহূর্তের বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়।

মাটির কিল্লার ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা চর রমিজ ইউনিয়নের ফর্সা চৌকষ চেয়ারম্যান আজাদ উদ্দিন, আজাদ মিয়া। গাঁয়ে সাদা গেঞ্জী, কোমড়ে লাল গামছা, উৎফুল্লতায় ব্যস্ত, আবেগের সন্ত্রস্ততা নিয়ে সভা পরিচালনা করছিলেন।

অনেকের মধ্যে এ মুহুর্তে যা মনে আছে স্থানীয় যারা কিল্লায়/মঞ্চে ছিলেন রামগতি থেকে নির্বাচিত এমসিএ সিরাজুল ইসলাম, এলাকার ও আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোশারেফ হোসেন মোশারেফ ভাই, রামগতি থানা কমান্ডার হাছান মাহমুদ ফেরদৌস, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, কচি ভাই, লক্ষ্মীপুরের শাহজাহান কামাল, খালেদ মোঃ আলী, নোয়াখালীর মোঃ হানিফ, চৌমুহনীর নুরুল হক মিয়া, মাইজদী থেকে আবদুল মালেক উকিল, হাজারো মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ।

হানিফ ভাই তাঁর আগের রাতে আলেকজান্ডারে আমাদের বাসায়ই ছিলেন, যাতে সকাল সকাল সময়মত সভায় থাকতে পারেন। এছাড়া আরো অনেক রাজনৈতিক নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, নোয়াখালী, ফেনী এলাকা থেকে পরিচিত আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে বাসায় রাতেই এসে অবস্থান নেয়। তখন ভাঙ্গা এবড়ো থেবড়ো কাঁচা রাস্তা-ঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল এবং যানবাহন গাড়ী বাস রিক্সাও তত ছিলনা-অনুন্নত। যুদ্ধ বিধবস্থ কোথাও কোথাও রাস্তা কাটা, ব্রীজ ভাঙ্গা, পোড়াবাড়ী ঘর দোকানপাট প্রায় সর্বত্রই দৃশ্যমান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিল্লায় দাড়িয়ে গগণবিদারী কন্ঠে কি কি বল্লেন সব স্মৃতিতে না আসলেও মূল কথাসমূহ মনে আসে যে ‘দেশ আমাদেরকেই গড়তে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রত্যেক বাড়ীতে একটি করে গাছ হলেও লাগাতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশ গড়া ও অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে’। সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে কোদাল হাতে নিয়ে স্বহস্তে মাটি কেটে ওড়াতে দিলেন। সফর সাথী নেতৃবৃন্দ একে একে একইভাবে মাটি কেটে রাস্তা নির্মানের, স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ উদ্বোধন করলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একই সঙ্গে ২ কি:মি: ব্যাপি ওড়া কোদালসহ সোজা লাইন ধরে প্রায় ৪ (চার) হাজার স্বেচ্ছা কর্মী মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ী যুবক গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরনে প্যাছ দেয়া লুঙ্গী গামছা পরে রাস্তা বরাবর একই সঙ্গে একই কমান্ডে ঢোল সহরতের তালে তালে মাটি কেটে রাস্তা বাঁধার কাজ শুরু হয়ে, সময়ের মধ্যেই শেষ হলো।

বঙ্গবন্ধু ইতোমধ্যে হাত ধুঁয়ে পাশ্ববর্তি তোফায়েল ভাইর দ্বীপ ভোলা জিরো পয়েন্ট উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার যোগে রওয়ানা হয়ে গেলেন। যে গ্রাম কিল্লায় দাড়িয়ে প্রথম দেশ গড়ার ভাষণ দিলেন, যেখান থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে নিজ হাতে মাটি কেটে নোয়াখালী-রামগতি আঞ্চলিক সড়ক বাঁধার কাজ উদ্বোধন করলেন, সেই কিল্লাই আজ ‘শেখের কিল্লা’ নামে পরিচিত-সর্বখ্যাত। এই কিল্লাকে ঘিরে ও পাশেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম ‘গুচ্ছগ্রাম’ যা আজ সারা দেশে ঠিকানা, আদর্শগ্রাম-গুচ্ছগ্রাম-আশ্রায়ন প্রকল্প নামে ভূমিহীন ছিন্নমূলদের জন্য স্থাপন হচ্ছে-চলমান। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি ৭০ এর ১২ নভেম্বর সাইক্লোনে বিধস্থ রামগতিতে সমবায়ের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের আশংকায় উৎপাদন যুদ্ধও চলমান ছিল।

এই কিল্লা ঘিরেই নতুন জাগা চরে আলু, সোয়াবীন, চিনাবাদাম, সূর্যমুখীসহ নানাজাতীয় শাক শবজি তরিতরকারী ফসল প্রদর্শনীমূলক চাষাবাদ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে এখন লক্ষ্মীপুর জেলাকে ‘সোয়াবীন জেলা’ বলা হয়। ১৯৭২ সালে সমবায়ীদের গড়া চর আলেকজান্ডারে দেশের প্রথম উদ্ভাবনী গুচ্ছগ্রাম ‘বিশ্বগ্রাম’ মেঘনার অতল গহবরে চলেগেছে। তৎস্থিত ‘বিশ্বগ্রাম’ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এই শেখের কিল্লার পূর্ব-উত্তর পাশে এসে আশ্রয় নিয়ে শিক্ষার আলোকবর্তিকা এখনও জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু যে ভাবে দেশটাকে স্বাধীন করেছেন, এগিয়ে নিয়েছেন, নিভৃত চর গ্রাম পোড়াগাছায় উন্নয়নের কাজের ডাক দিতে আগমন করেছেন, পথ দেখিয়েছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, ডাক দিয়েছেন উৎপাদনের, বৃহত্তর রামগতিবাসী আজ ধন্য। দেশব্যাপি তা ইতিহাসের অংশ। কৃষক শ্রমিক জেলেদের শেখের কিল্লা-বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লার স্বপ্ন আজ জাগরুক, পথ প্রদর্শক, বাতিঘর। প্রতিটি কিশোর কিশোরী জনতা আজ সংগ্রামী-জাগ্রত জনতা। এ দেশপ্রেমের চেতনা নিজের ভেতর ধারণ ও প্রস্ফুটিত করতে হয়। একে অংকুরিত করতে হয়। যত্ন করে লালন-বড় করতে হয়। দেশপ্রেমের এ চেতনায় নিজকে উদ্দীপ্ত করতে প্রয়োজন হয় দেশের ইতিহাস চর্চা ও এর ঐতিহ্য নিজেতে সঞ্চারিত করা। শেখের কিল্লা ঘিরে লিখতে ৭০ দশকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রামোন্নয়ন সর্বপ্রথম ডাকের কথা একজন সমবায়ী অ,আ-ক,খ লিখে বুকে ধারন করে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে দিব্যি স্মরণে আসে। যা আজ মহা উন্নয়ন সড়ক চোখে ভেসে উঠে।

আমরা সবাই যাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কীর্তিকে ব্যবহারিতায় আনতে পারি, তাই আজকের এই দিনের কামনা। ১৯৭২ সনের ভাষার মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর উৎপাদন উন্নয়ন ডাকের আজ ৪৮ বছর পূর্তি। আমাদের অগ্রগতি ও বিচ্যুতির হিসাব নিকাশ মূল্যায়নের পালা। সেবা ও ত্যাগের প্রকৃত ইতিহাস ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়তা-উচ্চতায় এগিয়ে যাওয়াই আজ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। রামগতি-সয়াবিন জেলা লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী তথা সাম্যতায় উন্নয়নকামী জনতার পক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা পাদদেশে আগমন করার সাদর আমন্ত্রণ জানাই- আল্লাহ কবুল করুন।

তাই এই অঞ্চলের মানুষের একান্ত আশা আবেদন ‘শেখের কিল্লা’কে ঘিরে গড়ে উঠা, আল্লাহর অপার সৃষ্টির জীবন গাঁথার কলকাকলী ভাঙ্গা গড়ার নদীর খেলাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর ‘প্রথম গ্রাম গমন, ঐতিহাসিক দেশ গড়ার ডাক’কে দেশের জন্য অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য বর্ণিত নির্দিষ্ট শেখের কিল্লা স্থানে ১. একটি স্বপ্ন স্মৃতি স্তম্ভ, ২. পর্যটক রেষ্ট হাউজ ৩. স্থানীয় কৃষ্টি কালচার, তাঁর ভাষণ ইতিহাসসহ পাঠাগার ৪. তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার তথা সারা গ্রামবাংলার ঐতিহাসিক ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্বপ্ন কমপ্লেক্স’ স্থাপন করা হউক।

ইতোমধ্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ী ও রাজনৈতিক সচেতনদের উদ্যোগে এ মাটি থেকে গড়ে উঠা বেসরকারি সংস্থা ‘ডরপ’ এর সৌজন্যে ‘শেখের কিল্লা মাইলষ্টোন’ স্থাপন করা হয়েছে যা এলাকা ও দেশ বিদেশের পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের ভ‚মি, স্থানীয় সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি, পর্যটন ও প্রত্নতত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষনসহ বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার ডাক এর স্মারক স্মৃতি স্বপ্ন কেন্দ্র তৈরীর আবেদন রাখছি। প্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পদার্পনে ‘গুচ্ছগ্রাম’ স্থাপন স্মরণে, ইউনিয়ন ভিত্তিক ৫ (পাঁচ) শ নদী ভাঙ্গা অসহায় গরীব পরিবারের জন্য সুউচ্চ প্রসাদ সম্পন্ন সামগ্রীক ও সমন্বিত উন্নয়ন পাইলট আবাসন গ্রাম স্থাপন করার আহবান জানাই।

৪৮ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এ দিন রামগতিতে ‘শেখের কিল্লা মাইলষ্টোন’ পাদদেশে মুক্তিযোদ্ধা, সমবায়ি, ছাত্র-শিক্ষক, স্কাউট, কৃষক, জেলে, জাতীয় ও স্থানীয় মিডিয়াসহ সবাই মিলে সার্বজনীন কর্মসূচি পালন করা হবে।

এএইচএম নোমান: প্রতিষ্ঠাতা, ডরপ ও রামগতি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী-২০১৩।

ই-মেইল: nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts