বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ এ বছর বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন এসএম রইজ উদ্দিন আহম্মদ। তাকে অনেকেই চেনেন না বলে জানিয়েছেন। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ফেইসবুকে লিখেছেন: ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজউদ্দীন, ইনি কে? চিনি না তো। নিতাই দাসই বা কে! হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার!’
এক সাক্ষাতকারে এসব কথার জবাব দিয়েছেন এসএম রইজ উদ্দিন আহম্মদ। যেখানে একটি ধারণা পাওয়া যায় এই লেখক সম্পর্কে। এসএম রইজ উদ্দিন বলেন-
ফেইসবুক আমি চালাই না। কে কী বলল আমার দেখার বিষয় না। তবে দু’একজন আমাকে কল করে জানিয়েছেন- বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান নাকি লিখছেন- ‘রইজউদ্দীন, ইনি কে?’ কিন্তু আমি তো বাংলা একাডেমির সদস্য। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন আমাকে বছরে তিন-চারবার ইনভাইট করতেন একাডেমির বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। একাধিক প্রোগ্রামে তার পাশাপাশি বসে আমি অনুষ্ঠান করেছি। আমাকে না চেনার দায় আমার নয়- এই দায়িত্ব তার। বাংলা একাডেমিতে আমার অনেক বই জমাও দেওয়া আছে।
তাছাড়া, আমি তো আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু না যে আমাকে ১৬ কোটি লোক চিনবে! তবে আমাকে বাংলাদেশের যত কবি সাহিত্যিক চেনেন, তাকে কিন্তু (শামসুজ্জামান খান) এত লোক চিনবে না। কারণ আমার একটা সংগঠন আছে গাঙচিল সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ; সেখানে বাংলাদেশ-ভারতসহ দেশ-বিদেশের হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক যুক্ত রয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে যারা অবহেলিত, যাদের লেখা কেউ আলোয় আনেনি, তাদের লেখা প্রকাশ, তাদের নিয়ে আমরা অনুষ্ঠান করি। কেউ যদি জেগে ঘুমের ভাণ করে, সেটা আমার দোষ না। আমাকে যে তার চিনতেই হবে, এমন কোনো যুক্তিও নেই। তিনি বাংলা একাডেমির দায়িত্বে ছিলেন বলে হয়তো বিজ্ঞ সমাজের কিছু লোক তাকে চেনেন।
তিনি বলেন, আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তখন থেকেই লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মে। এর মূল কারণ নড়াইল আমাদের এলাকায় বিজয় সরকারসহ কিছু কবিয়াল ছিলেন। তাদের গান আমাকে খুব আকৃষ্ট করতো। তারা মঞ্চে কত সুন্দর করে ছন্দে গাইতেন, আমি তাদের অনুকরণ করতাম, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছন্দ কাটতাম। খাতায় লিখে রাখতাম। এভাবে ধীরে ধীরে লেখার প্রতি আগ্রহ জন্মে। এক সময় গ্রামের লোকজন ‘কবি’ বলে ডাকতে শুরু করে। মানুষের মুখে মুখে এক প্রকার সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গেলে আমার লেখার গতি আরো বাড়ে। ছড়া কবিতার পাশাপাশি এক সময় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ইতিহাস ঐতিহ্য এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হই। আমার লেখায় ফুটে উঠতে থাকে প্রাণ প্রকৃতি, মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনা। যারা প্রান্তিকের মানুষ, কাদামাটিতে যাদের সংসার, তাদের নিয়ে আমার ভাবনা। এলিট সমাজ, ধনবান ব্যক্তি আর যারা ক্ষমতায় থাকে পারতপক্ষে আমি তাদের এড়িয়ে চলি। এলিটরা মানুষকে যেভাবে মূল্যায়ন করা দরকার, সেভাবে করে না।
তিনি বলেন, প্রথম লেখা কোথায় প্রকাশিত হয়েছে সেভাবে মনে নেই। তবে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সময়’ ‘লাটাই’সহ বেশ কিছু শিশুতোষ ম্যাগাজিনে আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘হ-য-র-ল-ব’। এটা নোয়াখালীর আশ্রাফিয়া প্রেস থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে তখনকার আন্দোলন, গণতান্ত্র, রাজনীতি, সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছড়া কবিতা ছিল। পরবর্তী সময়ে লিখেছি ‘ভূমি জরিপ ও ভূমি মালিক’ নামে একটি বই। ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি থামাতে এই বই, যাতে ভূমি মালিকেরা উপকৃত হয়। এই বইটি দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। এটা আমার লেখা বইয়ের মধ্যে বেস্ট সেলার বই।
আরেকটি ছড়া কবিতার বই ‘কেমন করে স্বাধীন হলাম’। এটা সম্ভবত ২০০৯ অথবা ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে তরুণ প্রজন্ম, বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীন হলো জানতে চায়। এই বইতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ছড়া-কবিতায় তুলে ধরেছি। আরেকটা বই লিখেছিলাম গাছের কথা, কোন ওষুধি গাছে কী উপকার হয়- এসব নিয়ে। লক্ষ্মীপুরে চাকরি করার সময় কিছু লোক ধরল- আপনি মাছের উপর লেখেন। তখন বাংলাদেশের যত মাছ আছে, সেসব নিয়ে একটা বই লিখলাম ‘মাছের কথা’। একবার সিরাজগঞ্জের ভক্তরা ধরলো- স্যার, আপনি পাখি নিয়ে লেখেন। তখন আবার পাখি নিয়ে একটা বই লিখলাম। পরে একটা লিখলাম ‘বাংলার যত ফুল’।
রইজ উদ্দিন বলেন, আমাদের একটা প্রকাশনী আছে- গাঙচিল। আমার বিশ-বাইশটি বই সেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কিছু রংধনু প্রকাশনী থেকে। প্রতি বছর একুশে বইমেলায় গাঙচিলের একটা স্টল থাকে- এবার আছে কিনা, খোঁজ নিতে পারিনি। আমার নিজস্ব লেখা বইয়ের সংখ্যা ৩০টি। তবে আমার সম্পাদিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে।
রইজ উদ্দিন বলেন, আমার ছড়া কবিতা তো আছেই। এরপর আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। যেমন বরিশাল বিভাগের ইতিকথা, খুলনা বিভাগের ইতিহাস, বৃহত্তর পাবনা জেলার ভূমি জরিপ ও ইতিহাস, নড়াইল জেলার ইতিহাস, কুমড়ী গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইত্যাদি। পত্র উপন্যাস লিখেছি, এমন লেখা বাংলাদেশে আগে কেউ লেখেনি- মৃত মানুষের কাছে চিঠি। আমার বন্ধু ছিল মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে সে মারা যায়, আজিমপুরে তার কবর। তাকে নিয়ে একটা লিখেছি ‘পরলোকে মর্তের চিঠি’। সরকারি চাকরি করতাম, সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা মুখ ফুটে বলতে পারতাম না, তাই পত্র উপন্যাসের আশ্রয় নিলাম।
১৮ বছর গবেষণা করে আরেকটা বই লিখেছিলাম- বাংলাদেশের নদনদী নিয়ে। বইটির নাম ‘বাংলাদেশের নদনদী ও গতি পরিক্রমা’। ১২ শ নদীর একটি তালিকা করেছিলাম, কোন অঞ্চল দিয়ে কোন জেলার কোন উপজেলার কোন কোন নদী আছে।
রইজ উদ্দিন বলেন, আমি যত বই ছাপিয়েছি, একটা বইও অবশিষ্ট নেই- সব বিক্রি হয়ে গেছে। আমার অনেক বই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স হিসেবে পড়ানো হয়। রাজধানীর কৌলিণ্যের মধ্যে যেসব বুদ্ধিজীবীর বসবাস তারা পড়ছে কিনা জানি না, তবে মফস্বলের যে কবি লেখক রয়েছেন- তারা আমার লেখা সম্পর্কে জানেন। গণমানুষ যেখানে মেধার স্বীকৃতি দিচ্ছে, সরকার দিচ্ছে, সেখানে তারা মানুষকে ছোট করার কে? তবে তারা আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত হলে তাদের ভুল ভাঙবে। আর কিছু লোক তো থাকেই, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়েও তারা বিদ্রূপ করতো। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় তাকে কবি বলেই স্বীকার করা হতো না! এখন বলা হচ্ছে- জীবনানন্দ আধুনিক বাংলা কবিতার জনক। কবি নজরুলকে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’তে কত কি যে লেখা হয়েছে!
স্বাধীনতা পদক পাওয়ার মূল্যায়নে রইজ উদ্দিন বলেন- এটা আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এখনও এটা আমার কাছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা আশ্চর্য মনে হয়। আমার চিন্তা ভাবনার বাইরে ছিল বিষয়টি। কোথায় যে বিবেচনা করা হলো, কারা কী করেছে আমি জানতামও না, খোঁজও নিইনি। একজন সচিব আমাকে ফোন করে পদকের কথা জানিয়েছেন। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। পরিচিত অনেকে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে, তারা বুঝে উঠতে পারছে না- ওই নামের ওই লোক আমি কিনা? খুলনা থেকে কালিপদ দাস (সংস্কৃতি) নামে একজনকে স্বাধীনতা পদক দিয়েছে। সেও আমার মতো নিভৃতচারী, তাকে নিয়েও অনেকে কথা বলছে। লাইমলাইটে না থাকলে যা হয় আরকি! পলান সরকার বইয়ের ফেরি করে বেড়াতেন, তিনি যদি স্বাধীনতা পুরস্কার পান, কালিপদ দাস পেলে দোষ কোথায়?
আমি তৃণমূলের হাজার হাজার কবি লেখককে উৎসাহিত করি। তারা অনেকে ভালো লিখছে, ওদের মধ্য থেকে হয়তো একদিন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ বেরিয়ে আসবে। হঠাৎ করে একদিন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে। আমাকে যে মূল্যায়ন করলো এটা আল্লাহপাকের অশেষ রহমত! আমাদের যারা বিচারক ছিলেন, তারা নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করেছেন বলেই পুরস্কারটি পেয়েছি।