রাহুমুক্তি’র মহাকবি যাযাবর ওসমান

আতাতুর্ক পাশা
যাযাবর ওসমান

‘রাহুমুক্তি’ মহাকাব্য প্রণেতা যাযাবর ওসমানের জন্ম ১৯৪০ সালে। ১৯৭১ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার বয়স ৩০ বছর। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই বিশ্বের প্রথম রাজনীতিবিদ যিনি মহাকাব্যের মহানায়ক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে। যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।

‘বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ধরণের কাহিনীকাব্য এই প্রথম। ‘রাহুমুক্তি’ বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধশালী করবে। ইতিমধ্যে এর ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।’

এ কথাগুলো আমার নয়, লিখেছিলেন মুহম্মদ আসাদ সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ১৯১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি সংখ্যায়। গত ১৭ এপ্রিল এ মহাকবির ৮১তম জন্মদিন আর ৮০তম জন্মবার্ষিকী পেরিয়ে গেল।

আসলেই এ কবি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ করেছেন। মাইকেলের পর দীর্ঘদিন বাংলায় মহাকাব্য পশ্চিম বাংলায় এবং পূর্ব বাংলায় কাউকে লিখতে দেখা যায়নি। ১৯৫৭ সালে তিনি বুনাগাতী আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এবং পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে মাগুরা জেলার শ্রীরামপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৯৬৫ সালে রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা কেন্দ্রীয় সরকারি বালক-বালিকা বিদ্যালয়ে সিনিয়র ইংলিশ টিচার হিসেবে যোগ দেন। দেশ স্বাধীন হলে পরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন।

লেখালেখির নেশা তাঁর শৈশব থেকেই ছিল। ষাট দশক থেকেই যাযাবর ওসমান নাম পাঠক সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মূলতঃ তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপরই লেখালেখি করেন। গণতন্ত্রের ওপর একটি লেখা প্রকাশ পাবার পর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রায় আনাই হয়ে গিয়েছিল যার কারণে হয়ত তাঁকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান কারাগারে দন্ড ভোগ করতে হতো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি আফগানিস্তান দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

প্রথম জীবনে তিনি Nawab Abdul Latif, the Pioneer of Muslim Modernism in Bengal নামে একটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। শুরু হয় তাঁর কাব্য ও গদ্য রচনা। একসময় দৈনিক বাংলার বাণী এবং অবজারভারে একইসাথে বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর বই প্রকাশ হতে থাকে। তিনি এ পর্যন্ত অনুবাদসহ ষোলটি বই লিখেছেন। এর ১৩টি ইংরেজি ও বাংলায় কাব্যগ্রন্থ এবং দু’টি মহাকাব্য ও একটি ইংরেজি উপন্যাস। তিনি বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ণের ওপর সোচ্চার থেকেছেন এবং আজো।

তাঁর চৌদ্দ পংক্তির লেখা ‘রাহুমুক্তি’ আধুনিক একটি বাংলা মহাকাব্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষক বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও পৃথিবীর দুর্ধর্ষ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এবং ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বাঙালির মরণ ছোবল ও পরিশেষে বাংলাদেশ নিয়ে এ মহাকাব্য প্রসঙ্গে প্রয়াত গুণীজন কবীর চৌধুরী লিখেছেন, পনর পর্বে রচিত এই মহাকাব্যখানি আখ্যান বস্তুর চমৎকারিত্বে, ভাষার লালিত্য ও গাম্ভীর্যে, ভাবের গভীরতা ও মৌলিকতায়, মানব জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি উপলব্ধিতে, উচ্চাঙ্গের কাব্য রসবোধে এবং চরিত্রের মানবিক ও অলৌকিক মহিমায় ভাস্বর।

মহাকবি মাইকেলের ৯৫ বছর পর যাযাবর ওসমান লেখেন এই মহাকাব্য। গত তিন হাজার বছরে লেখা মহাকাব্যগুলো পাঠ করলে একটি মহাকাব্যের সচরাচর খুবই সংক্ষেপে হলেও কিছু বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ১] এতে কিছু দেবতাদের উপস্থিতি থাকে যারা ঈশ্বরের সাথে কথা বলার ক্ষমতা রাখে। ২] আকাশের উর্ধে, স্বর্গে এবং পাতালে অনেক ভ্রমণ করার ঘটনা থাকে। ৩] এতে ভয়াবহ যুদ্ধের বর্ণনা থাকে এবং উচ্চাভিলাসী উপমাগুলো দিয়ে কল্পনাকে প্রসারিত করা হয় যেখানে সাহিত্যের গৌরব অর্জনের প্রয়াস থাকে। ৪] অনেক ধরণের অস্ত্র ও যুদ্ধের বর্ণনায় সেনাবাহিনীর বীরত্বব্যঞ্জক পরিচয় থাকে যেখানে সেনাবাহিনীর কৌশল একটি ক্লাসিক অবদানের সৃষ্টি করে। ৫] মহাকাব্যের পরিসর অন্য যে কোন কবিতার চেয়ে বৃহত্তর। এসব বিবেচনা করলে ‘রাহুমুক্তি’ ভাষার বিচারে, ক্লাসিক দর্পণে, বর্ণনার নিপুনতায়, শৌর্য-বীর্যের আখ্যানে একটি শ্রেষ্ঠ আধুনিক মহাকাব্য।

যাযাবর ওসমানের সাম্প্রতিক আর একটি শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘Democracy Wins’ মহাকাব্য। কলম্বাস ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের অগাস্টে আমেরিকা আবিস্কারের পর সেখানে আস্তে আস্তে স্প্যানিশ, ওলন্দাজ, দিনেমার ও বিলেতী জাতিসহ বেশ কিছু বহিরাগতের আগমন ঘটে। কিন্তু স্থানীয়দের খুবই দ্রুত পরাজিত করে, দাস বানিয়ে বিলেতীরা বিশাল এ ভূখন্ড অধিকার করে নেয়। দু’শো বছর ধরে এ ভূখন্ডে চালায় অমানুষিক বর্বরতা এবং শাসনের নামে শোষণ এবং লুটতরাজ। এই বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে একদিন স্থানীয় ইয়াংকিরা, স্থানীয় দাসরা সংঘবদ্ধ হয় এবং মার্কিন মুল্লুক স্বাধীন করবার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশেষে অনেক রক্তক্ষয় ও জীবনক্ষয় দিয়ে তারা তাদের দেশ ব্রিটিশমুক্ত করেন এবং গণতন্ত্রের জয় হয়। ভাষা, আইয়ামবিক প্যান্টামিটারের শৈলীতে, রচনার নিপুনতায় এটি বিশ্বে শাহানামার পর দ্বিতীয় বৃহৎ মহাকাব্য। শাহানামা ৬০ হাজার পংঙতিক্তিতে লেখা হয়েছিল, এটি লেখা হয় ৩৩ হাজার পংঙক্তিতে।

মহাকাব্য একটি বিশাল ব্যাপার, তা যে কোনো ভাষাতেই হোক। সারাবিশ্বে মহাকাব্যের সংখ্যা ২৩-২৪টির বেশি নয়। জাপানি কাব্য সাহিত্যেও কোনো এপিক লেখা হয়েছে বলে আজও শোনা যায়নি। মহাকাব্য- এটি লিখতে গেলে লেখকের নিজস্ব মেধা ছাড়াও অধ্যবসায় প্রয়োজন। সে কাজটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদী লেখক যাযাবর ওসমান করলেন। বাংলা ভাষায় মহাকাব্য লেখা ছাড়াও এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপজীব্য করে তিনি লিখলেন ডেমোক্রেসি উইনস্‌। তিনি এ পর্যন্ত ইংরেজিতে মোট আটটি ও বাংলায় আটটি বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে মূল্যবান অনেক কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ রয়েছে। লেখকের লেখার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের অনেকেই পরিচিত নন। তবে তাঁর লেখা থেমে নেই। এবার তিনি নিয়ে এলেন ইংরেজিতে একটি মহাকাব্য। পৃথিবীর সেরা মহাকাব্যের যা গুণাবলি থাকে, তার সবই রয়েছে এ মহাকাব্যে। এ মহাকাব্যে তিনি ব্রিটিশ শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

সম্পূর্ণ বইটি ২৯টি সর্গে (Canto) বিভক্ত। The natives who, for centuries together,/ Where living in their ancestral homestead/In peace and tranquility, left no stone/Unturned to protect their land, culture and/Tradition; they virtually led a/Nomadic life, …(সর্গ-২, পৃষ্ঠা/৩১)। বছরের পর বছর, যুগ যুগ ধরে এই মহাদেশে রেড ইন্ডিয়ান জাতি, যাযাবর, স্থানীয় মানুষ বসবাস করে আসছিল শান্তিতে, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যের শিখরে। হঠাৎ তাদের নদীবন্দরে এলো ব্রিটিশ এক নৌবহর। তীরে নেমেই তারা স্থানীয় মানুষদের বন্দুক ও অন্যান্য মারণাস্ত্রের মুখে কব্জা করে তাদের একরের পর একর জমি দখল করতে থাকল। স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার শুরু করল। তাদের দাস, ক্রীতদাস বানাল। স্থানীয়রা নিজেদের মাটিতে পরবাসী হয়ে পড়ল আর বিলেত থেকে আসা আগন্তুকরা হয়ে উঠল মহাদেশটির মালিক।

এভাবে খুবই দ্রুত সেখানে বিলেতি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলো, বিলেতের রাজা নিজের অধ্যাদেশ জারি করল তাদের ওপর। ২০০ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল। দেশবাসীর মনে জেগে ওঠে ক্ষোভ। সে ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নেয়। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। কিন্তু যে বিলেতি সরকারের সাম্রাজ্যে অস্ত যায় না, তারাও কি সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র! এর পরও uprising of slaves, Boston -এর Rebellion-দের বিরুদ্ধে ম্যাসাকার চালানো হলো, সারা আমেরিকায় বিলেত সরকার তার করাল দাঁত বসিয়ে দিল, এক কথায় স্টিম রোলার চালানো হলো। The call for war, when the people heard, they came/Out from homes and thronged in the prominent/ places viz markets, ports and harbours, then/ they discoursed within themselves and set out/ For Boston where the first massacre took/ Place; the British troops were utterly ruined/ And finally were constrained to retreat. …’ (সর্গ-৯, পৃষ্ঠা/২০৩)। সরকারের যাঁতাকলের মুখেও ইয়াংকিদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করা গেল না। অবশেষে দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিদেশি সরকার পরাভব স্বীকার করল এবং তাদের নৌবাহিনীর জাহাজগুলো হাডসন নদীবন্দরসহ একে একে আমেরিকার সব বন্দর ত্যাগ করল। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেককে প্রাণ দিতে হলো। কিন্তু তবুও বিশ্বের গণতন্ত্র রক্ষা পেল।

একটি উন্নত মহাকাব্যে যে গুণাবলি থাকে, যে বিশাল যুদ্ধবিগ্রহ, হতাহত, নিহত, স্বাদেশিকতার বিশাল ত্যাগ, তার সবই রয়েছে এই ‘ডেমোক্র্যাসি উইনস্‌’য়ে। ইংরেজি ভাষায় পুরো মহাকাব্যটি Iambic pentameter-এ লেখা হয়েছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে অত্যন্ত সুপেয় সুপাঠ্য সর্গগুলো। বাঙালির হাত থেকেও যে এত সুন্দর ইংরেজি কাব্য বেরিয়ে আসতে পারে তার একটি নিপুণ দলিল এই মহাকাব্যটি। (কালের খেয়া, দৈনিক সমকাল)

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts