বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ প্রতারণায় সাহেদ ছিল এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি যখন যেখানেই সাচ্ছন্দ মনে করেছেন সেখানেই প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন। যাকে দরকার তাকেই হাসিল করেছেন। নিজের প্রভাব তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্নজনদের সাথে ছবি তোলাসহ হেন কোন প্রক্রিয়াই বাদ রাখেননি তিনি। যতই দিন যাচ্ছে একটার পর একটা চমক খবর উপহার দিচ্ছেন সাহেদ। তা এতটাই বিস্তৃত যে, এখন তার পাশে অনেকেই নিজের ছবি দেখে লজ্জা পাচ্ছেন।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের প্রতারণার জাল কেবল স্বাস্থ্য খাত বা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল তার প্রতারণার জাল। চাকরি দেওয়ার নামে হাজারো মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাত্ করেছেন। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় করে গ্রাহকের কাছ থেকে ।
তার ছিল নিজস্ব টর্চার সেল এবং ৩০ সদস্যের নারী বাহিনী। নির্যাতন করা হতো পাওনা টাকা চাইতে এলেই। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন তিনি। অনেক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার নাগাল পায়নি কেউ। কারণ সবকিছু ম্যানেজ করতেন টাকা দিয়ে ও সুন্দরী নারী দিয়ে মনোরঞ্জনের মাধ্যম। নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তা বা মন্ত্রী-এমপির সহযোগী পরিচয়ে সারা দেশেই চালিয়েছেন রমরমা প্রতারণা বাণিজ্য। ঢাকার বাইরে থেকেও বেরিয়ে আসছে তার ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র।
মহাপ্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে সিলেটের জৈন্তাপুর থানায় আরো তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা নম্বরগুলো হলো—৩৫ (১) ২০২০, ৩৬ () ১ ( ২০২০ ও ৩৭ (১) ২০২০। মাওলা স্টোন ক্র্যাশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হাজী শামসুল মাওলা তার কাছে ৩০ লাখ পান। তার থেকে ৩২ লাখ টাকার পাথর নিয়ে আসলেও মাত্র ২ লাখ টাকা দিয়েছে। বাকি ৩০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিল। কিন্তু চেক ডিজঅনার হওয়ার পর মামলা হয়। ওয়ারেন্টও ইস্যু হয়। কিন্তু তিনি হাজিরা দেননি। পাওনা টাকা চাইলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় তার বিরুদ্ধে একটি জিডি করা হয়েছে।
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হওয়ার পর সারা দেশে সাহেদের প্রতারণার শিকার শত শত মানুষ টেলিফোনে কিংবা সরেজমিনে এসে র্যাবের কাছে অভিযোগ করছেন। সাহেদ পুলিশে বড় ধরনের বদলি ও পদোন্নতির বাণিজ্য করেছেন। ওসি, এসপি, এএসপিদের পদোন্নতি দেওয়ার নামে বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সাপ্লাইয়ের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামেও অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন সাহেদ। তিনি যখন যা মনে করতেন, তখন তাই করতেন। তার ৩০ সদস্যের সুন্দরী নারী বাহিনী ছিল। কাউকে টাকা দিয়ে আবার কাউকে সুন্দরী নারী দিয়ে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে ফেলতেন। এ কারণে তাকে কেউ কিছু করতে পারত না। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও খায়েশ ছিল তার। সাতক্ষীরা থেকে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যে কোনো মুহূর্তে প্রতারক সাহেদকে গ্রেফতার করা হবে।
এদিকে কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) চিকিত্সা নিয়ে প্রতারণা করা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদের গ্রেফতারের বিষয়ে শিগিগরই তথ্য দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ‘যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে সাহেদকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ শুক্রবার রাজধানী ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মন্ত্রী। নানা অনিয়ম, প্রতারণা, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ, করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, চিকিত্সায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রধান কার্যালয়, উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গা ঢাকা দিয়েছেন হাসপাতালের মালিক সাহেদ। সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে র্যাব। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ।
জানা গেছে, ব্যাবসায়িক অংশীদাররাও রক্ষা পাননি সাহেদের হাত থেকে। বিভিন্ন সময়ে পাওনা পরিশোধের কথা বলে ঢাকা অফিসের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সাহেদের স্ত্রীর মুখেও উঠে আসে তার নানা অপকর্মের চিত্র। সাহেদের বিচারও দাবি করেন স্ত্রী সাদিয়া।
সাহেদ প্রতারণায় ছাড় দেননি নিজের পরিবারকেও। সাহেদের স্ত্রীর মুখে উঠে আসে তার নানা অপকর্মের চিত্র। সাহেদের বিচারও দাবি করেন স্ত্রী সাদিয়া। সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া গণমাধ্যমকে জানান, শাহেদের প্রতারণার শুরু হয় ২০০৮ থেকে। পরিবারের লোকদের সাথেও প্রতারণা করতো সে। এটা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। এই প্রতারকের বিচারও চান তিনি।
সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া বলেন, কয়েকবার আমি তার কাছ থেকে চলেও গেছি। আমার পরিবারের কয়েকজনের সাথেও তার টাকা পয়সা নিয়ে গণ্ডগোল ছিলো। ওনার জন্য আমার পরিবারের অন্যরাও সমস্যায় আছে।
জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং সুবিধা পাওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরেই সাহেদ ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করতেন। এভাবে রিজেন্ট গ্রুপসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে তিনি মো. সাহেদ নামে নিজে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পরিচয় দিলেও নেতারা জানিয়েছেন, এ পরিচয়টিও ভুয়া।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে ঢোকার প্রবেশ মুখেই বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এখান থেকেই সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই ভবনটিতে কী কী আছে। ভবনটিতে ছিল সাহেদের নিজস্ব টর্চার সেলও। টাকা চাইতে এলেই করা হতো নির্যাতন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতারণার শিকার কয়েক জন ভুক্তভোগী বলেন, সাহেদের কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। টাকা চাওয়ামাত্রই তার লোকজন আমাদের দুই হাত ধরে থেকে ঐ রুমটি দরজা বন্ধ করে দিল। এরপরই তিনি আমাদের মারধর করতে থাকেন। এমনকি পাওনাদারকে নারী দিয়ে হেনস্তা করাও ছিল সাহেদের অন্যতম কাজ। ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করতে পারত না সাহেদের বিরুদ্ধে।
র্যাব বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আয়ই ছিল সাহেদের কাজ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে আমরা অ্যানাকোন্ডা পেয়েছি। এত দিন প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকার অর্জন করেই তিনি অবস্থানে এসেছেন। যখনই কারো সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তখন তিনি নিজেকে আর্মির মেজর, কখনো কর্নেল পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন আইডি কার্ড তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে প্রতারণা করেছে।