বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী মারা গেছেন। পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
দেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত মজবুত করতে তার ভূমিকা এবং ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের কারণে বাংলাদেশে দেওবন্দের অনুসারী আলেমদের কাছে শতবর্ষী আহমদ শফী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, তাকে ডাকা হত বড় হুজুর বলে।
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টে ভোগার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত কারণে গত কয়েক বছর ধরেই আহমদ শফীর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের আকস্মিক বিক্ষোভের জেরে বৃহস্পতিবার তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং এর পরপরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ইসলামী ঐক্য জোটের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আলতাফ হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ থেকে উনাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে সন্ধ্যার আগে আগে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির পরপরই তিনি ইন্তেকাল করেন।
আহমদ শফী হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে পরিচিত আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালকের (মুহতামিম) দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন সেই ১৯৮৬ সাল থেকে।
দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দেশের অন্যতম পুরনো এ কওমি মাদ্রাসার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন।
কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্বের উপর ভর করেই তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসা হেফাজতে ইসলামের আমিরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আহমদ শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে তার ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের’ কথাও তারা স্মরণ করেন।
হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক দশক আগে পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে শাহ আহমদ শফীর নাম, যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেওবন্দ ঘরানার আলেমদের শ্রদ্ধা; আবার নানা মন্তব্য আর কর্মকাণ্ডের কারণে বার বার সেই নামের সঙ্গী হয়েছে বিতর্ক। নারী শিক্ষার বিরোধিতা, ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে নানা বক্তব্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ ও প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বার বার।
আহমদ শফী তার শত বছরের জীবনের অর্ধেকটাই পার করেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায়। দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দেশের অন্যতম পুরনো এ কওমি মাদ্রাসাকে স্থানীয়রা চেনেন হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে। আর ১৯৮৬ সাল থেকে সেই মাদ্রাসার মহাপরিচালকের (মুহতামিম) দায়িত্ব পালন করে আসা শফী ছিলেন তার অনুসারীদের কাছে ‘বড় হুজুর’।
মাদ্রাসার শূরা কমিটির সদস্য ও নানুপুর মাদ্রাসার মহাপরিচালক সালাউদ্দিন নানুপুরীর ভাষায়, আল্লামা আহমদ শফী ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বড় মুরুব্বি ও আলেম। কওমি মাদ্রাসা ঘরানায় তার মত বড় ব্যক্তি আর নেই।
ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের কারণে সমমনা আলেম আর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে আহমদ শফী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তবে বহু মতে বিভক্ত বাংলাদেশের কওমি ধারাগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারা ছিল তার বড় কৃতিত্ব। এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের কওমি ধারার আলেমদের শীর্ষ নেতা।
অবশ্য শেষটা সুখের হয়নি। নিজের মাদ্রাসায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে বৃহস্পতিবার তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এর পরপরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এনেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে মারা যান হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী।
তার ছাত্র ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বড় হুজুর ছিলেন সারা দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ শিক্ষাগুরু। নাস্তিক্যবাদী আন্দোলনসহ বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ রূপকার তিনি।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা শাহ আহমদ শফীর বয়স নিয়ে তার অনুসারীদের মধ্যেও মতভেদ আছে। তবে ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহর ভাষ্যে, ‘বড় হুজুরের’ বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর।
তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
তার দুই ছেলের মধ্যে আনাস মাদানি হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক।
নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ২০১১ সালে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষণা করলে তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। মূলত তখন থেকেই শফীর নাম সারা দেশে ছড়াতে থাকে।
যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তির দাবিতে সক্রিয় হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি।
ওই দাবিটি সামনে রেখেই তারা সে সময় ১৩ দফা দাবিতে ন্দোলন শুরু করে, যার মধ্যে কয়েকটিকে ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলেন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
‘ইসলামবিরোধী’ নারীনীতি, ‘ধর্মহীন’ শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করারও দাবি ছিল সেখানে।
যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা করায় হেফাজতকে সে সময় ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সংগঠনকে তিনি ‘আল-বদর’ ও ‘রাজাকারদের’ উত্তরসূরিও বলেছিলেন।
ওই ১৩ দফা দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ এবং পরে ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি দেয় হেফাজতে ইসলাম। অবরোধ কর্মসূচি শেষে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এবং এইচ এম এরশাদের দল জাতীয় পার্টিও সে সময় হেফাজতের কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়।
শাপলা চত্বরে ওই অবস্থান ঘিরে দিনভর পুলিশের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষ চলে। মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশ এলাকায় ফুটপাতের শত শত দোকান ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে কওমি শিক্ষার্থীরা। তাণ্ডবের শিকার হয় আশপাশের অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।
শাপলা চত্বরের সেই সমাবেশে হেফাজত আমির আহমদ শফীরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি লালবাগের একটি মাদ্রাসাতেই অবস্থান করেন।
সেই রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে হেফাজতকর্মীদের মতিঝিল থেকে তুলে দেওয়া হয়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হেফাজতের তাণ্ডবে সেদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
শাপলা চত্বরের ওই ঘটনার পর ‘অরাজনৈতিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব’ শফী রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। সরকারের পদস্থ ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, বিদেশি কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে আহমদ শফীর সাথে দেখা করতে শুরু করেন।
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক ওয়াজে নারীদের নিয়ে আহমদ শফীর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ওই বছরের শেষভাগে আহমদ শফীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান দেশের নারীনেত্রী ও অধিকারকর্মীরা।
পরে ওই বছরের ২ নভেম্বর এক সভায় আহমদ শফী বলেন, তিনি মহিলাদের ‘রানীর সাথে’ তুলনা দিয়েছেন, ‘ফুলের সাথে’ তুলনা দিয়েছেন।
এ কথা বুঝে নাই। সরকারও বুঝে নাই। সরকারের মন্ত্রীরাও আমার কথা বুঝে নাই। আমি মহিলাকে তেঁতুলের মতো বলেছি, তেঁতুল বলি নাই। এরা কিছু বুঝে না।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই যাওয়ার পর তাতে বিভিন্ন ভুল-ক্রটির পাশাপাশি বেশ কয়েকজন লেখক-কবির রচনা বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানা যায়। ভুল-ত্রুটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনার পাশাপাশি লেখা বাদ দেওয়ার পেছনে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার অভিযোগ ওঠে।
সে সময় হেফাজত আমির আহমদ শফী এক বিবৃতিতে তাদের ‘দাবি মেনে’ স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ‘নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়বস্তু’ বাদ দেওয়ায় সরকারের প্রশংসা করেন।
শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিল। তাদের দাবির পর ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে গড়া ভাস্কর্য সরিয়ে নেয় সরকার।
ওই বছর ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফীসহ কয়েকশ আলেমের উপস্থিতিতে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে আইন পাস হয়।
সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও আলেমদের উপস্থিতিতে শোকরানা সমাবেশ করে কওমির ছয় বোর্ডের সমন্বিত সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশ। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান আহমদ শফী সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘শুকরিয়ার স্মারক’ তুলে দেন।
কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায়কেও আহমদ শফীর বড় সাফল্য হিসেবে দেখেন তার অনুসারীরা।
সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, “ইসলামী দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা গত ৫০ বছরে কেউ রাখেননি। হাটহাজারী মাদ্রাসার উনি যে খেদমত করেছেন তা অনস্বীকার্য।”
তবে জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সেই মাদ্রাসাতেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দেখতে হয়েছে ‘বড় হুজুর’ শফীকে।