বাংলাদেশের ফুটবল কিংবদন্তি বাদল রায়ের বিদায়

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ আশির দশকে ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো বাদল রায় আর নেই। রাজধানীর ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। রেখে গেছেন স্ত্রী এবং এক ছেলে ও মেয়ে।

গত ৫ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ বাদলকে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে ছয় দিন পর নেওয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালে। সেখানেই লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই সাবেক তারকার। ক্যান্সার চতুর্থ পর্যায়ে থাকায় তিনি ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শনিবার তাকে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

এর আগে ২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় মোহামেডানের সাবেক অধিনায়কের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর সেরে উঠলেও মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ ছাপ ফেলে যায় শরীরে। মহামারি করোনায় আক্রান্ত হন আগস্টে।

খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর সংগঠক হিসেবে দেশের ফুটবল উন্নয়নে অবদান রেখেছেন বাদল। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া সাবেক তারকা ফুটবলার ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ সভাপতি। এবার সভাপতি পদে কাজী সালাহউদ্দিনের বিপক্ষে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন বাদল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এক ঘণ্টা দেরীতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করায় নির্বাচনে ব্যালটে তার নাম ছিল। নির্বাচনের মাঠে অনুপস্থিত থাকলেও ৪০ ভোট পেয়েছিলেন জনপ্রিয় এ সাবেক ফুটবলার।

আশির দশকের অন্যতম সেরা তারকা ফুটবলার বাদল। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন বহুদিন। ১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তার গোলেই মালয়েশিয়াকে হারিয়ে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় মোহামেডানের হয়ে খেলা এই তারকা ফুটবলার ১৯৯০ সালে অবসরে যান। অবসরের পর রাজনীতিতে নাম লেখান। ব্যবসায়ী হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ৯০’এর দশকে বেশ কয়েকবার তিনি মোহামেডানের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেছেন।

হাজার ভক্তের হৃদয়ে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেই ৬৩ বছর বয়সে বিদায় নিলেন রক্ত-মাংসের সেই বাদল রায়, একজন সত্যিকারের কিংবদন্তি।

১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্ম এই কিংবদন্তির। নিজ এলাকায় ফুটবলের হাতেখড়ি হয় তার। পড়ালেখার পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ফুটবলে দারুণ পারফরম্যান্সে জনপ্রিয় হতে থাকেন লিকলিকে শরীরের বাদল। আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দলের হয়ে নিয়মিত খেলার ডাক পেতেন সদ্য কলেজে যোগ দেওয়া এই ফুটবলার।

ক্লাব ফুটবলের অভিজ্ঞতাও হয়ে যায় দ্রুতই। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে সিএন্ডবি’র হয়ে যাত্রা শুরু। এরপরের বছর সুযোগ মেলে ইয়ংম্যান স্পোর্টিংয়ের হয়ে। তবে তখনও দ্বিতীয় বিভাগে খেলতেন। পরের বছর অবশেষে প্রথম বিভাগ ফুটবলেও নাম লেখান। আর বাদলকে সেই সুযোগ দেন ইয়ংম্যান সোসাইটি। আর এই দলের হয়ে খেলতে গিয়ে সাদা কালো জার্সিধারী মোহামেডানের হয়ে খেলার সুযোগ মেলে এই ফুটবলারের।

১৯৭৬ সালে মোহামেডানের ফুটবলাররা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে কুমিল্লায় যান। আর সেখানে প্রতিপক্ষ দলের হয়ে আলো ছড়িয়ে মোহামেডানে আসার সুযোগ করে রাখেন নিজেই। পরের বছরে কুমিল্লা ছেড়ে বাদল রায়ের ঠিকানা হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব মোহামেডানে।

সেই পথচলা চলে পরের ১৩ বছর। মোহামেডানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন বাদল রায়। ১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপে ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মোহামেডানের জার্সিতে নামেন ১ম ম্যাচ খেলতে। থামেন ১৯৮৯ সালে। এর মাঝে সাদা কালো জার্সিধারীদের হয়ে অধিনায়কত্বও করেছেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মোহামেডানকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়েছেন লিগ শিরোপা। এছাড়াও খেলোয়াড় হিসেবে মোহামেডানের জার্সিতে জিতেছেন ছয়টি শিরোপা। ক্যারিয়ারের শুরুতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও পরবর্তীতে হয়ে যান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। তবে গোল করার অভ্যাস ঠিকই ধরে রেখেছিলেন তিনি।

বিশেষ করে চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর জালে বল জড়াতে বেশ পটু ছিলেন বাদল রায়। এক যুগেরও বেশি ক্যারিয়ারে আবাহনীর বিপক্ষে ভিন্ন পাঁচ ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল। আর বাদলের গোল মানে দলের জয়। আবাহনীর বিপক্ষে ওই পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতে হেরেছে মোহামেডান।

বাদলের গোল মানে দলের জয়, জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও কথাটি ছিল দারুণ সত্য। জাতীয় দলেও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে খেলা বাদল করিয়েছেন অনেক গোল। কিন্তু যখনই গোল করেছেন, জয় দেখেছে জাতীয় দল। ১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তার গোলেই মালয়েশিয়াকে হারিয়ে ১ম জয় পায় বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সাদা দলের। প্রেসিডেন্টস গোল্ড কাপ নামে এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে এই ‘প্রায় মোহামেডান’ দলটিকে সেমিফাইনালে তোলেন অধিনায়ক বাদল।

ক্যারিয়ারে নিজের পারফরম্যান্সে নিজেকে নিয়ে যান কিংবদন্তিদের কাতারে। মাঠ ছাড়ার পরেও সংগঠক হিসেবে ফুটবলের সঙ্গেই ছিলেন। ক্যারিয়ারে যেমন মোহামেডানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও সাদা কালোদের শিবিরে ছিলেন। ক্লাবটির ম্যানেজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদেই ছিলেন লম্বা সময় ধরে। বাফুফের সহসভাপতি পদও রাঙিয়েছিলেন।

বিদায়বেলায় শরীরটা বড্ড কষ্ট দিয়েছে এই কিংবদন্তি ফুটবলারকে। ২০১৭ সালে ব্রেন স্ট্রোক দিয়ে শুরু। এরপর চলতি বছরের শুরুতে আবারও করেন স্ট্রোক। সেখান থেকে শরীর চলতে শুরু করতে করোনার আক্রমণ। এরপর চতুর্থ স্তরের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। শরীরের সঙ্গে না পেরে প্রাণের সংগঠন বাফুফের নির্বাচনে থাকতে পারেননি, থাকতে পারেননি পৃথিবীর বুকেও।

কাতার থেকে শোকার্ত বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ‘জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফুটবলার এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সহ-সভাপতি বাদল রায়ের মৃত্যুর খবর কাতারে আমাদের জন্য অনেক বড় হৃদয় বিদারক ঘটনা হিসেবে এসেছে। দেশ বাসীর মতো আমিও অনেক মর্মাহত ও দুঃখিত। ভালো থাকবেন কিংবদন্তি।

Print Friendly

Related Posts