মো. কবির হাসান
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং বর্তমান সময়ে খুবই আলোচিত বিষয়। র্যাগিং হলো ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিকর বা বেদনাদায়ক এবং আক্রমনাত্বক ব্যবহার যা যার প্রতি করা হয় তার নিজেকে তা হতে রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে যায়। শুধুমাত্র সহপাঠী বা শিক্ষার্থী নয় শিক্ষক বা অভিভাবকদের দ্বারাও র্যাগিং হতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে নিজেদের জাহির করার লক্ষ্যে ভিকটিমকে হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করা মূলত র্যাগিং এর প্রধান উদ্দ্যেশ্য।
সাধারণত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থী এবং চলাফেরায় সহজ-সরল শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয়। র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থী মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়ে এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা লজ্জায় প্রকাশও করতে পারে না। ফলে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ট্রমায় ভুগতে থাকে। স্বাভাবিকভাবে যেকোন শিক্ষার্থীর নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মেনে নিতে খুবই সমস্যা হয়। এই সমস্যাময় অবস্থায় যদি কোন শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের স্বীকার হয় তাহলে সে এই যন্ত্রণাদায়ক চাপ অনেক সময় সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এরকম ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে অনেক।
একটু পেছনে তাকালেই দেখা যাবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যা করেছিল র্যাগিংয়ের কারণে। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে চার জন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়েছে। ২০২০ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর, ২০২১ সালে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০তম ব্যাচের শাহরিয়ার, ২০২২ সালে ফিসারিজ অনুষদের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সানাউল্লাহ্, সর্বশেষ এবছরের ৭ ফেব্রুয়ারি র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর
লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন স্থাপত্য বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান।
মেধার তিব্র লড়াই করে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও শুধু বিকৃত মানসিকতার মানুষের আক্রমনের শিকার হয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ত্যাগের ঘটনাগুলো খুবই বেদনাদায়ক। এরকম বহু ঘটনা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে থাকে যার অধিকাংশই প্রকাশ্যে আসে না কারণ যারা র্যাগিংয়ের শিকার হয় তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও সম্মানের কথা ভেবে ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চায় না।
আশার কথা হলো এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং (Ragging) প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা’ প্রকাশিত হয়েছে। এই নীতিমালায় র্যাগিংয়ের বিভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই সাথে র্যাগিংয়ের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালার
চার (০৪) নং ধারায় সাত ধরণের র্যাগিংয়ের বর্ণনা রয়েছে।
এক. মৌখিক র্যাগিং: কাউকে উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন করা বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা, গালিগালাজ করা, শিস দেওয়া, হুমকি দেওয়া ইত্যাদি।
দুই. শারীরিক র্যাগিং: কাউকে কোন কিছু দিয়ে আঘাত করা, হাত দিয়ে চড়-থাপ্পর, পা দিয়ে লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা দেয়া, থুথু দেওয়া, বেঁধে রাখা, কোনো বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়াতে বা বসতে বাধ্য করা।
তিন. সামাজিক র্যাগিং: ব্যাঙ্গ করে সামাজিক স্ট্যাটাস দেওয়া, কারো সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা জাত তুলে কোন কথা বলা।
চার. সাইবার র্যাগিং: বন্ধুদের মধ্যে কারো সন্মন্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কটু কিছু লিখে বা অশালীন কিছু পোস্ট করে তাকে অপদস্থ করা।
পাঁচ. সেক্সুয়াল র্যাগিং: ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিজনক স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, ইঙ্গিতবাহী চিহ্ন প্রদর্শন, কয়েকজন মিলে জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা খুলতে বাধ্য করা, শরীরে পানি বা রং ঢেলে দেয়া ইত্যাদি।
ছয়. জাতিগত র্যাগিং: জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, পেশা, গায়ের রঙ, অঞ্চল ইত্যাদি নিয়ে কাউকে অপমান ও হেয় করা।
সাত. অন্যান্য র্যাগিং: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং (Bulying)/ র্যাগিং (Ragging)/ হেজিং (Hazing)/ ফ্যাগিং (Fagging) বা অন্য যে নামেই হোক না কেনো তা অন্যান্য র্যাগিং নামে অভিহিত হবে।
এই সাত প্রকারের যে কোন একটি বা একাধিক ধরণের র্যাগিংয়ের যদি কেউ শিকার হয় তাহলে সর্বপ্রথম তাকে এই বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসা উচিত। প্রথম প্রতিবাদ ভিকটিমের পক্ষ থেকেই হওয়া দরকার তবে প্রতিবাদ বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সাহসকরে প্রকাশ্যে নিয়ে আসাকে। এ ধরণের প্রতিবাদের উত্তম উদাহরণ হতে পারে কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোছা. ফুলপরী খাতুন। তিনি যদি তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা সাহস করে প্রকাশ্যে না নিয়ে আসতেন তাহলে হয়ত বিষয়টি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতো। আর নির্যাতনকারীদের কোন শাস্তিও হতো না। তিনি হৃদয়বিদারক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন জন্যই আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্যাতনকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে পেরেছে।
যেকোন শিক্ষার্থী তার বাবা-মা, পরিবার, প্রিয়জনের কাছে অমূল্য সম্পদ। পরিবার তাকে অনেক আদর-ভালবাসা, দরদ দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলে। অনেক পরিবার নিজেদের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের চাহিদা পূরণ করে বড় করে তোলে। অথচ যারা র্যাগিংয়ের সাথে জড়িত তারা কখনও ঐ শিক্ষার্থীকে একবেলা খাওয়ায়নি, কোন চাহিদা পূরণ করেনি, সুখে দুখে পাশে থাকেনি, জীবনযুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে সে পথ পারি দিয়েছে সেখবরও তারা রাখেনি কখনও। তাই কোন নতুন শিক্ষার্থী অথবা সহজ সরল শিক্ষার্থীদের র্যাগিং দেওয়ার কোন অধিকারই তো তাদের নাই। তারা যে দলই করুক না কেন, যে মতের আদর্শই লালন করুক না কেন, তারা ঐ দল ও জাতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়। এরা বিপজ্জনক। এদের প্রতিহত করতে হবে। প্রতিবাদে এদের রক্তচক্ষু, রক্তমেজাজ, বিকৃত রুচির কালো দাঁত ভেঙ্গে দিতে হবে।
র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সরকারী নীতিমালার ব্যাপক প্রচার দরকার। সেই সাথে শুধু আইনে সীমাবদ্ধ না থেকে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা প্রত্যাশা করি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিনিয়রদের সাথে জুনিয়রদের, শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীর, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক ফুলের মতো কোমল ও পবিত্র হোক।
লেখক : প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।