মেট্রো নিউজ : চাঞ্চল্যকর দুটি শিশুহত্যা মামলার রায়ে ঘাতকদের ফাঁসির আদেশ হলো। বিচার পেল রাজন-রাকিবের স্বজন। সম্প্রতি সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও তোলপাড় করা চাঞ্চল্যকর দুটি শিশুহত্যা মামলার রায়ে মোট ৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত।
সিলেট ও খুলনার আদালতে পৃথক দুটি মামলার চূড়ান্ত রায়ের তারিখই ছিল রোববার। ফলে দেশব্যপিই এই দুই আদালতের দিকে ছিল সারাদেশের কৌতুহলী দৃষ্টি। আদালত প্রাঙ্গণে ছিল উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভিড়।
সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যায় মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চার জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। রোববার সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা এই রায় দেন।
রায়ে মামলার ১৩ আসামির মধ্যে খালাস পেয়েছেন তিন জন। কামরুলের তিন ভাইয়ের হয়েছে সাত বছর করে কারাদন্ড। বাকিদের মধ্যে এক জনের যাবজ্জীবন এবং দুই জনের এক বছর কারাদন্ড হয়েছে।
রায়ে এক বছর করে কারাদন্ড হওয়া দুইজনকে এক হাজার টাকা করে এবং দন্ডপ্রাপ্ত অন্যদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদয়ে তাদেরকে আরও ২ মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
গত ৮ জুলাইয়ের ওই হত্যাকান্ডের বিচার শুরুর পর মাত্র ১৭ কার্যদিবসে ঘোষিত হলো দেশজুড়ে আলোচিত এই হত্যা মামলার রায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল মামলার বিচার।
রায় উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মামলায় গ্রেপ্তার ১১ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় রাজনের খুনিদের ফাঁসির দাবিতে সেøাগান দেন হাজারো মানুষ। আসামিকে লক্ষ করে তাদের অনেকে জুতাও নিক্ষেপ করেন। বেলা সোয়া ১টার দিকে রায় দেন বিচারক।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আদালতের পিপি মফুর আলী জানান, প্রত্যাশিত রায়ই হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ রায় ঘোষণা বিচার বিভাগের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে দেশে শিশু নির্যাতন কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আসামিপক্ষের আইনজীবী হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, পূণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। এসময় উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা আক্তার। রাজনের বাবা বলেন, “দ্রুত রায় ঘোষণা হওয়ায় আমরা খুশি।”
দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “রায় কার্যকর হলেই রাজনের আত্মা শান্তি পাবে।” গত ২৭ অক্টোবর মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে একই বিচারক রায়ের দিন ঠিক করে দেন। রায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেন পাভেল আহমদ।
রায়ে খালাস পেয়েছেন- ফিরোজ মিয়া, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিন। যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে নুর মিয়ার। সাত বছর করে কারাদন্ড হয়েছে- কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদের। এক বছর করে দন্ড হয়েছে দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীর। কামরুলের আরেক ভাই শামীম আহমেদ ও জাকির হোসেন পাভেল আহমেদ পলাতক রয়েছেন।
গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এরপর মাস না ঘুরতেই ৩ অগাস্ট খুনলার টুটুপাড়া কবরখানা মোড়ের মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়া কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় ১২ বছরের শিশু রাকিব হাওলাদারকে। আলোচিত ওই হত্যাকান্ডের রায়ও আজ হয়েছে। এতে দুই জনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে এবং আরেক জন খালাস পেয়েছেন।
সিলেটে রাজন হত্যার দেড় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে ১৬ অগাস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুরঞ্জিত তালুকদার।
আসামিরা হলেন- সদর উপজেলার শেখপাড়ার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম, তার ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদ, পাভেল আহমদ, ময়না চৌকিদার, রুহুল আমিন, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল, দুলাল আহমদ, নুর মিয়া, ফিরোজ মিয়া, আজমত উল্লাহ ও আয়াজ আলী।
রাজন হত্যার পর ১০ জুলাই সৌদি আরব পালিয়ে যান মূল অভিযুক্ত কামরুল। গত ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে পরদিন আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কামরুলকে নিয়ে এই মামলার আসামিদের মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১ অক্টোবর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জন সাক্ষ্য দেন আদালতে।
তবে মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামের আইনজীবীর আবেদনে ১১ সাক্ষীর পুনরায় জবানবন্দি শোনে আদালত। ২১ অক্টোবর শেষ হয় পুনঃসাক্ষ্যগ্রহণ।
রাকিব হত্যায় শরীফ-মিন্টুর মৃত্যুদন্ড : খুলনায় নির্মম কায়দায় শিশু রাকিব হাওলাদারকে (১২) হত্যার দায়ে দুই আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিলরুবা সুলতানা রোববার এই রায় দেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- শরীফ মোটর্সের মালিক ওমর শরীফ ও তার দূরসম্পর্কের চাচা মিন্টু মিয়া।
বাদীপক্ষের আইনজীবী বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী মোমিনুল ইসলাম জানান, মামলার আরেক আসামি শরীফের মা বিউটি বেগমকে খালাস দিয়েছে আদালত।
নগরীর টুটুপাড়া কবরস্থান মোড়ে ‘শরীফ মোটর্স’ নামে একটি ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কম্প্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় রাকিবকে। রাকিব ওই ওয়ার্কশপে কাজ করত।
লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কম্প্রেসার মেশিনের মাধ্যমে দেওয়া বাতাসের চাপে কিশোর রাকিবের পেটের ভেতরের নাড়ি, মলদ্বার, মুত্রথলি ফেটে অতিরিক্তি রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পরপরই ওমর শরীফ, তার মা বিউটি বেগম এবং দূরসম্পর্কের চাচা মিন্টু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা নূর আলম হওলাদার ছেলে রাকিবকে হত্যার ঘটনায় ওই তিনজনকে আসামি করে খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে তিন আসামিই রাকিবকে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।
গত ২৫ অগাস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা সদর থানার এসআই কাজী মোস্তাক আহমেদ তিনজনকে আসামি করে খুলনা মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন। গত ৫ অক্টোবর খুলনা মহানগর ও দায়রা জজ আদালত বিচার শুরুর আদেশ দেয়। বিচার চলাকালে মামলার চার সাক্ষী নাদিম হাসান শাহীন, রবিউল ইসলাম, সুমন ও সেলিম হাওলাদার আদালতে জবানবন্দি দেন। যুক্তিতর্ক শেষে গত ১ নভেম্বর একই বিচারক রায় ঘোষণার দিন জানিয়ে দেন।
রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি রাজনের বাবা-মার : সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন তার বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা আক্তার। রোববার দুপুর আলোচিত ওই মামলার রায়ের পর রাজনের বাবা বলেন, “দ্রুত রায় ঘোষণা হওয়ায় আমরা খুশি।” এসময় দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “রায় কার্যকর হলেই রাজনের আত্মা শান্তি পাবে।”