মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ। সুন্দরবনের ভারসাম্য ধরে রাখা সেরা এই প্রাণিটি চোরা শিকারি, বনদস্যুদের দাপট, অভয়ারণ্যে অবাধ যাতায়াত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ভালো নেই।
গত কয়েক দশকে সুন্দরবনে কমেছে বাঘের সংখ্যা। কমেছে বাঘের শিকার প্রাণির সংখ্যাও। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায়।
এদিকে, সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে নতুন করে বাঘ গণনা শেষ হয়েছে। সুখবর এই যে, প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ জরিপে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির আভাস মিলেছে। আজ (২৯ জুলাই) সোমবার বিশ্ব বাঘ দিবসে তৃতীয় বাঘ জরিপের ফল ঘোষণার কথা ছিল। এ বছর বাঘ দিবসের মূল আকর্ষণ ছিল বাঘশুমারির ফলাফল প্রকাশ। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসে ফল ঘোষণা করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর সুরক্ষা, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাঘের শিকার প্রাণির সংখ্যা বাড়াতেও কাজ করতে হবে বন বিভাগকে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে শুমারি হয়। এ বছরের প্রথম দিকে বনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জেও একই পদ্ধতিতে শুমারি করা হয়েছে। ৪০ দিন ধরে প্রতিটি রেঞ্জের ১৪৫টি পয়েন্টে দুটি করে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। এ ছাড়া সুন্দরবনে খাল সার্ভের মাধ্যমে বাঘের পায়ের ছাপ সংগ্রহ করা হয়। প্রায় চার মাস আগে শুমারির মাঠ পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, বাঘের প্রায় সাড়ে সাত হাজার ছবি পাওয়া গেছে। একই বাঘের ছবি পাওয়া গেছে বহুবার। এজন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিটি বাঘের ‘ইউনিক আইডি’ করা হয়েছে। এসব ছবি বিশেষজ্ঞদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। তারা সেগুলো বিশ্লেষণ করছেন।
তিনি বলেন, এবারের বাঘ দিবসে শুমারির তথ্য প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু আন্দোলন ও কারফিউর কারণে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। সেজন্য আগামী মাসে ফল ঘোষণা করা হবে।
বন বিভাগ জানায়, বনে অভয়ারণ্য বাড়ানো এবং সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করাসহ নানা উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। যার সুফলও মিলতে শুরু করেছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির সাড়ে ১০ লাখেরও বেশি ছবি পাওয়া যায়। এরমধ্য থেকে সাড়ে ৭ হাজার বাঘের ছবি নিয়ে চলে বিশ্লেষণ, যা শেষ হয়েছে ৭ জুলাই। এই সাড়ে ৭ হাজার বাঘের ছবি থেকে ইউনিক বাঘের ছবি নির্ধারণ করতে এখন চলছে বিশ্লেষণ।
গবেষণায় জড়িত বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, প্রাকৃতিক কারণে সুন্দরবনের জল ও স্থলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে; যার প্রভাব পড়েছে বাঘের অবস্থান ও ঘনত্বেও। গেলো দুই জরিপে খুলনা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা কম পাওয়া গেলেও এবারে তা বেড়েছে। মোট বাঘের সংখ্যায় এর প্রতিফলন ঘটবে, বলছে বন বিভাগ।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, গত দুই বছর ধরে আমরা সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঘের ছবি সংগ্রহ করেছি। এবারের জরিপে আমরা প্রচুর বাঘের ছবি পেয়েছি। আমরা প্রায় সাড়ে ১০ লাখ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ছবি পেয়েছি, সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাঘের ছবি পেয়েছি, এখান থেকে আমরা ধীরে ধীরে ইউনিক বাঘ কতটি সেটি বিশ্লেষণ করছি।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে লবণাক্ত এলাকা থেকে যে এলাকায় লবণ কম সেখানে বাঘের ছবি অনেক বেশি পেয়েছি।
সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, সুন্দরবনের সঙ্গে বাঘের সম্পর্ক নিবিড়। সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাঘকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বাঘকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধুমাত্র বাঘ জরিপ করলে বা বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নিলেই হবে না, সুন্দরবনের পুরো ইকো সিস্টেমকে নিয়েই কাজ করতে হবে। বাঘের শিকার প্রাণির সংখ্যা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে হরিণ ও শুকরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বাঘের নিরাপদ প্রজনন ও আপদকালীন সময়ে বাঘের নিরাপদ স্থান তৈরি করে দিতে হবে। সব মিলিয়ে বন বিভাগকেই দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সুন্দরবন বিভাগের সূত্র জানিয়েছেন, বাঘ জরিপ ছাড়াও তিন বছরমেয়াদী বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম, বাঘের আপতকালীন আশ্রয়ের জন্য ১২টি মাটির কেল্লা নির্মাণ করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।