সকল সূচকে রূপালী ব্যাংক ‍এখন উর্ধ্বমুখী অবস্থানে ||এম ফরিদ উদ্দিন

[এম ফরিদ উদ্দিন ২০১০ সাল থেকে রূপালী ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর পাহাড়সম পুঁঞ্জিভূত লোকসান আর শ্রেণিকৃত ঋণের জঞ্জাল পার করে ব্যাংকটিকে এখন সকল সূচকে উর্ধ্বমুখী অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। তার চৌকষ দায়িত্বপালন সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। নিষ্ঠতা আর পরিশ্রমে তিনি এখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে একজন আইকনে পরিনত হয়েছেন।

দেশ-বিদেশে অনেক স¤মাননা পেয়েছেন এই ব্যাংকিং আইকন। পেশাগত উন্নয়ন ও প্রয়োজনে তিনি দেশে-বিদেশে অনেক প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছেন। কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার আর সম্মাননা। ‍এরমধ্যে রয়েছে- ২০১২ সালের শ্রেষ্ঠ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপালী ব্যাংকের পক্ষে Arthakantha Business Award-2012 গ্রহণ। ২০১৪ সালের শ্রেষ্ঠ ব্যাংক হিসেবে রূপালী ব্যাংকের পক্ষে Business Excellence Awards Singapore-2014 গ্রহণ। ব্যাংকিং খাতে বিশেষ অবদানের জন্য সৃজন বার্তা, কোলকাতা কর্তৃক Srijan Barta Moitry Sammanana-2014 লাভ। ব্যবসায়িক ক্ষমতা তফসিল হালনাগাদ করার জন্য জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক Letter of Appreciation লাভ। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক Letter of Appreciation লাভ। ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জনতা ব্যাংক লিমিটেড ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক হতে নগদ পুরস্কার লাভ।]

farid-uddin

বিডি মেট্রোনিউজের পক্ষ তার মুখোমুখি হলে তিনি খোলামেলা অনেক কথা বলেছেন। এখানে এই বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথোপকথন হুবহু তুলে দেওয়া হলো:

সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার আলমগীর কবির পলাশ

বিডি মেট্রোনিউজ : রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান কত সালে?

এম ফরিদ উদ্দিন :২০১০ সালের ১৮ মার্চ তারিখে আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রূপালী ব্যাংকে যোগদান করি।

 

বিডি মেট্রোনিউজ : এরপর থেকে আজ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের অগ্রগতি কতটা?

এম ফরিদ উদ্দিন : আমি যখন রূপালী ব্যাংকে যোগদান করি, ব্যাংকে তখন পাহাড়সম পুঁঞ্জিভূত লোকসান আর শ্রেণীকৃত ঋণ, পদোন্নতি, জনবল নিয়োগ, বিনিয়োগসহ ব্যাংকিং ব্যবসায়ের সবগুলো কার্যক্রমই ছিলো বন্ধ প্রায়। আস্থাহীনতা থেকে আমানতকারীরা তখন এ ব্যাংক থেকে তাদের আমানত প্রত্যাহার করে নিচ্ছিলো। যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় ব্যাংকটিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিণত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে ব্যাংকটি মর্যাদাশীল অবস্থানে রয়েছে।

 

বিডি মেট্রোনিউজ : ব্যাংকের সার্বিক উন্নয়নে এর মধ্যে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

এম ফরিদ উদ্দিন : বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবসায়ের প্রায় সকল সূচকে আমাদের অবস্থান উর্ধ্বমুখী। রূপালী ব্যাংক এখন সর্বস্তরের মানুষের আস্থার একটি ব্যাংক। গত ৬ বছরে বিভিন্ন গ্রেডে ৩১৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রূপালী ব্যাংক হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনার মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষ মানবস¤পদে পরিণত করার লক্ষ্যে ৫৫৭টি কোর্সের আয়োজন করা হয় যাতে ১০৭৪৬ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে ১০জন মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে ১০টি বিভাগীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যবসায় সম্প্র্রসারণের লক্ষ্যে ৬০টি শাখাকে কর্পোরেট শাখায় উন্নীত এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকের অংশগ্রহণকে আরও বিস্তৃত করতে ২৮টি এডি শাখার কার্যক্রমকে সম্প্র্রসারিত করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন গ্রেডে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা মোট ৩৬৮৯ জন। ব্যাংকে প্রথমবারের মতো ১৭ জন উপ-মহাব্যবস্থাপককে সম্প্রতি মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। ইতোপূর্বে এ কার্যক্রম অর্থ মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক স¤পাদিত হতো। মাত্র ০৫ বছরের ব্যবধানে ৫০টি নতুন শাখা খোলা হয়েছে যা এ ব্যাংকের জন্য একটি নতুন মাইল ফলক। রূপালী ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং রূপালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড নামে দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যাংকের সকল শাখায় কম্পিউটার স্থাপন ও অটোমেশন (Live Operation) নিশ্চিত করা হয়েছে। শাখাসমূহকে centralized banking এর আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের মধ্যে ১০০% CBS বাস্তবায়ন করা হবে। Co-branded ATM সেবা প্রদানের জন্য এ পর্যন্ত ৪৪টি এটিএম স্থাপন করা হয়েছে। রূপালী ব্যাংক নিজস্ব ব্র্যান্ডের এটিএম খোলার চিন্তাভাবনা করছে। এক কথায় বলতে গেলে যুগোপোযোগী সকল ধরনের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাথে সমানতালে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাচ্ছে রূপালী ব্যাংক।
বিডি মেট্রোনিউজ : ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় আপনার দৃষ্টিতে রূপালী ব্যাংক কোন্ পর্যায়ে রয়েছে?

এম ফরিদ উদ্দিন : আমি মনে করি এক্ষেত্রে রূপালী ব্যাংকের অবস্থান সুদৃঢ়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক প্রেক্ষাপটে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি একটু আগেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ১০জন মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে ১০টি বিভাগীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। এর ফলে মাঠ পর্যায়েই অনেক বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে মহাব্যবস্থাপক পদায়নের কারণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স¤পর্ক নিবিড় হয়েছে। জাতীয় প্রচার মাধ্যমে অন্যান্য ব্যাংক সম্পর্কে কতিপয় নেতিবাচক সংবাদ দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এধরনের দৃষ্টান্ত নেই। রূপালী ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সাফল্যের এ দিকটি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।
বিডি মেট্রোনিউজ : ব্যাংকিং খাতে আরো বেশি উন্নতি করতে হলে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

এম ফরিদ উদ্দিন : স্বাধীনতার পর গত কয়েক দশকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এগিয়ে যেতে ব্যাংকগুলো পরিপূরক ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণ করে চলেছে। ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংকের আগমনের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা এখন আরো প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি যেহেতু global shape নিয়েছে, ব্যাংকিং ব্যবসাকেও এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবী। যদিও এর জন্য প্রযুক্তিগত উতকর্ষের পাশাপাশি পেশাগত দক্ষতাও আবশ্যক।

আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ সে সামর্থ্য অর্জনের পথে। দেশীয় পরিমন্ডলে ব্যাংকিং খাতের কয়েকটি দিককে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। প্রথমতঃ ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে অনাদায়ী ঋণ আদায়ে বিপুল সংখ্যক মামলা নিস্পত্তির অপেক্ষায় আছে। দ্রুত এসব মামলা নিস্পত্তির মাধ্যমে ঋণ আদায়, ব্যাংকগুলোকে শ্রেণীকৃত ঋণের রাহু থেকে মুক্ত করতে পৃথক বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব মামলা দ্রুত নিস্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাংকে অতি দ্রুত অটোমেশন সম্পূর্ণ করতে হবে। এটা সম্পন্ন করতে পারলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর এক নতুন যুগে পদার্পণ করবে। ব্যাংকগুলো বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি pro-people হতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করতে সর্বস্তরের মানুষকে banking channel এ নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষের বিপুল সংখ্যক ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে, window/POS open, agent banking, SMS/mobile/internet banking ইত্যাদি সকল ধরনের অত্যাধুনিক ব্যাংকিং সেবা সর্বস্তরে সম্প্রসারণ করতে হবে।

 

বিডি মেট্রোনিউজ : বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে? এতে কোনো প্রকার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কি?
এম ফরিদ উদ্দিন : বর্তমানে দেশে সরকারি, বেসরকারি, বিদেশি, বিশেষায়িত, ইসলামীসহ তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৫৬টি। এছাড়া কয়েকটি non-scheduled bank এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট নিয়ম-বিধির মধ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমি মনে করি প্রত্যেকে যদি দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে বিধি মোতাবেক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাহলে দেশের অর্র্থনীতিতে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কারণ নেই। তবে এসব ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদারী ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিতকরণ এবং regulatory authority-র যথাযথ নজরদারি অত্যন্ত জরুরী।

 

বিডি মেট্রোনিউজ : শিল্প বাণিজ্যের উন্নয়নে ব্যাংকগুলো এখন কি ধরনের ভূমিকা পালন করছে? এক্ষেত্রে আপনার কোনো দিক-নির্দেশনা আছে কি?

এম ফরিদ উদ্দিন : দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সিংহভাগের অংশীদার বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ৫৬টি ব্যাংক। গত এক দশকে বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার নেপথ্যে রয়েছে ব্যাংকের অর্থায়ন। স্বাভাবিক নিয়মেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাংকগুলোর এ অংশহগহণ অব্যাহত থাকবে। তবে ব্যাংকগুলোর অর্থায়নের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। তা হলো কোনো একটি বিশেষ sector এ একই সময়ে বিনিয়োগ করার প্রবণতা। এতে দ্রুত market saturated হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচীর পরিপূরক অর্থায়ন কৌশল অবলম্বন করলে দেশের সুষম উন্নয়ন দ্রুত ও নিশ্চিত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts