এদিকে বুধবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে এক ছাত্রীর বক্তব্য নিয়েছে পুলিশ। সেখানে মামলার তদন্ত সংস্থা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সদস্য ও ছাত্রীর মা উপস্থিত ছিলেন। মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতনের বিবরণ শুনে অচেতন হয়ে পড়েন ওই ছাত্রীর মা। পরে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বক্তব্য শেষে ছাত্রী ও তার মাকে বাসায় পাঠানো হয়। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিহ্নিত দুই ধর্ষক সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ এবং তাদের তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দাবি, বুধবারও রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় নিষ্ফল অভিযান চালানো হয়েছে।
ধর্ষণের শিকার এক ছাত্রী জানান, তাদের পরিবারকে নানা মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুরো ঘটনা নিয়ে প্রভাবশালী আসামিদের পক্ষ থেকে সমঝোতার হুমকি দেওয়া হয়। কত টাকায় তারা সমঝোতা করতে ইচ্ছুক, সেটা জানতে চায় তারা। মামলায় কিছুই হবে না বলেও তাদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুই তরুণীর বাসার সামনেও অপরিচিত লোকজন ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ পরিচয়ে এক নারী বাদীর বাসায় গিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ারও চেষ্টা করেছে।
মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের অন্যতম কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে। দ্বিতীয় আসামি নাঈম আশরাফ ই-মেকার্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। মামলার এজাহার অনুযায়ী দুই ধর্ষকের সহযোগী তিন আসামির মধ্যে একজন সাদমান সাকিফ রেগনাম গ্রুপের পরিচালক। তার বাবা দেশের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। তার বাবার নাম মো. হোসেন জনি। অন্য দুই আসামি সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও তার দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ।
বুধবার মামলার বাদীর বক্তব্য নেওয়ার সঙ্গে জড়িত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সব তথ্য-উপাত্ত ও ভুক্তভোগীর বক্তব্য শোনার পর তারা নিশ্চিত হয়েছেন, দুই তরুণী যা বলছেন, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বাদীর বাসায় পুলিশ পরিচয়ে কে এই নারী :
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী বলেন, অনেক হুমকি-ধমকি ও টানাহেঁচড়ার পর তিনি মামলা করতে পেরেছেন। ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি চান তিনি, যাতে ভবিষ্যতে কেউ কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন জঘন্য আচরণ করতে না পারে।
নানাভাবে হুমকি :
এক তরুণী বলেন, অনেক ফোনে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। বাসার সামনে অপরিচিত লোকজন ঘোরাফেরা করে। কেউ কেউ ফোন দিয়ে খুব আন্তরিক আচরণ করেন। এর ফাঁকেই বিত্তশালী আসামিদের ভয়াবহতা তুলে ধরে মীমাংসা করে ফেলতে অনুরোধ করছেন। এমন অনুরোধে বুঝতে বাকি থাকে না এরা আসামিদেরই লোকজন। ওই তরুণী বলেন, সবকিছু মিলিয়ে তারা এখন ফোন ধরতেও আতঙ্কবোধ করেন। বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করার পর এখন তারা ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছেন।
নাঈম আশরাফের প্রকৃত পরিচয় :
বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন জানান, ধর্ষণ মামলায় দুই নম্বর আসামির নাম নাঈম আশরাফ উল্লেখ থাকলেও তার বাবার নাম অজ্ঞাত ছিল। ঠিকানা শুধু মিরপুর লেখা ছিল। তবে তদন্তে তার প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে আসে। হালিমের বাবা আমজাদ হোসেন এক সময় ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতেন। ক্ষেতমজুর হিসেবে মাঠেও কাজ করতেন। কিছু দিন আগে হালিম তার মা-বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যান। হালিম ঢাকায় দুটি বিয়ে করেছেন বলে গ্রামবাসী জানেন।
কাজীপুরের গান্দাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী বলেন, তিনি আবদুল হালিমের পুরো পরিবারকে চেনেন। সে অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। হালিম এলাকায় একজন ভণ্ড হিসেবে চিহ্নিত।
গত বছর তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা থেকে ফোন পান। তাকে বলা হয়, তার ছেলে ‘নাঈম আশরাফ’ এক শিল্পপতির মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়ে দেখেন তার ছেলে পরিচয়ধারী তারই এলাকার আমজাদের ছেলে আবদুল হালিম। এরপর ঢাকায় তিনি আবদুল হালিমের নানা অপকর্মের কথা জানতে পারেন।
কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে হালিমের লাগানো বিভিন্ন পোস্টার-ব্যানারও এলাকায় রয়েছে। ২০০৪ সালে গান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে হালিম। ওই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় স্কুলের শিক্ষকের পরিচয় দিয়ে রাজশাহী বোর্ড থেকে প্রশ্নপত্র এনে ফেঁসে যায় সে। এরপর বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করা অবস্থায় সিরাজগঞ্জ শহরের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে বিত্তশালী পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করে। পরিচয় জানার পর হালিমকে মারধর করে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেন তারা। হালিম অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ‘বাবা’ বলে পরিচয় দিত।
সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা বলেন, তার সাবেক স্বামীকে নষ্ট পথে নিয়েছে এই প্রতারক ‘নাঈম আশরাফ’।
নাঈম আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের গান্ধাইলে জানতে পেয়ে সিরাজগঞ্জে অবস্থানরত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ধর্ষককে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। বুধবার রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই ধর্ষক ভুয়া নাম ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে ভুয়া রাজনৈতিক পরিচয় দিচ্ছে। যেকোনো মূল্যে তাকে গ্রেফতারের জন্য সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছি। ধর্ষককে পাওয়া না গেলে মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য বলেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।