ভয়ংকর বিপদে দুই ধর্ষিত ও তাদের পরিবার

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়েরের পাঁচ দিন পরও আসামিরা ধরা পড়েনি। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতারে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ঘটনাটি সমঝোতার জন্য দুই ছাত্রীর পরিবারকে চাপ ও প্রলোভন দেখানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। নামে-বেনামে ফোন করে সমঝোতার কথা বলা হচ্ছে।
গুলশান সোসাইটির সেক্রেটারি পরিচয়ে  বুধবার এক ছাত্রীর মাকে ফোন করে সমঝোতার কথা বলা হয়। তবে গুলশান সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার ওমর সাদতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তরুণীর পরিবারের সদস্যদের ফোন করার প্রশ্নই আসে না। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে।’

এদিকে বুধবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে এক ছাত্রীর বক্তব্য নিয়েছে পুলিশ। সেখানে মামলার তদন্ত সংস্থা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সদস্য ও ছাত্রীর মা উপস্থিত ছিলেন। মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতনের বিবরণ শুনে অচেতন হয়ে পড়েন ওই ছাত্রীর মা। পরে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বক্তব্য শেষে ছাত্রী ও তার মাকে বাসায় পাঠানো হয়। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিহ্নিত দুই ধর্ষক সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ এবং তাদের তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দাবি, বুধবারও রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় নিষ্ফল অভিযান চালানো হয়েছে।

ধর্ষণের শিকার এক ছাত্রী জানান, তাদের পরিবারকে নানা মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুরো ঘটনা নিয়ে প্রভাবশালী আসামিদের পক্ষ থেকে সমঝোতার হুমকি দেওয়া হয়। কত টাকায় তারা সমঝোতা করতে ইচ্ছুক, সেটা জানতে চায় তারা। মামলায় কিছুই হবে না বলেও তাদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুই তরুণীর বাসার সামনেও অপরিচিত লোকজন ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ পরিচয়ে এক নারী বাদীর বাসায় গিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ারও চেষ্টা করেছে।

মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের অন্যতম কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে। দ্বিতীয় আসামি নাঈম আশরাফ ই-মেকার্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। মামলার এজাহার অনুযায়ী দুই ধর্ষকের সহযোগী তিন আসামির মধ্যে একজন সাদমান সাকিফ রেগনাম গ্রুপের পরিচালক। তার বাবা দেশের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। তার বাবার নাম মো. হোসেন জনি। অন্য দুই আসামি সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও তার দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ।

বুধবার মামলার বাদীর বক্তব্য নেওয়ার সঙ্গে জড়িত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সব তথ্য-উপাত্ত ও ভুক্তভোগীর বক্তব্য শোনার পর তারা নিশ্চিত হয়েছেন, দুই তরুণী যা বলছেন, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

বাদীর বাসায় পুলিশ পরিচয়ে কে এই নারী :

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মামলার বাদী এক ছাত্রীর গুলশানের বাসায় এক নারী প্রবেশ করেন। সাদা পোশাকের ওই নারী বাড়ির গেটে পুলিশ পরিচয় দেন। তিনি ভেতরে ঢুকে তরুণীর বক্তব্য কাগজে লেখেন। একপর্যায়ে একটি সাদা কাগজে তরুণীকে স্বাক্ষর দিতে বলেন। এতেই ওই তরুণীর স্বজনদের সন্দেহ হয়। তারা পুলিশ পরিচয় দেওয়া নারীকে চ্যালেঞ্জ করে তার পরিচয়পত্র দেখতে চান। এরপর ওই নারী ‘পুলিশকে সহায়তা’ না করার অভিযোগ তুলে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে একটি গাড়িতে করে চলে যান। বুধবার ছাত্রীর পরিবারের এক সদস্য  এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা সন্দেহ করছেন পুলিশ পরিচয় দেওয়া ওই নারীকে প্রভাবশালী আসামিরাই পাঠিয়েছিল। হয়তো মামলা প্রত্যাহারের জন্যই সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চেয়েছিল। স্বাক্ষর নেওয়ার পর ঘটনা মীমাংসার জন্য সমঝোতার কথাও হয়তো বলা হতো। তবে ওই নারীর আচরণ সন্দেহ হলে তিনি দ্রুতই বাসা থেকে বের হয়ে যান। বিষয়টি পুলিশকেও অবহিত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী বলেন, অনেক হুমকি-ধমকি ও টানাহেঁচড়ার পর তিনি মামলা করতে পেরেছেন। ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি চান তিনি, যাতে ভবিষ্যতে কেউ কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন জঘন্য আচরণ করতে না পারে।

নানাভাবে হুমকি :

ঘটনার শিকার দুই তরুণী বলেন, তাদের মোবাইল ফোনে অনেকে ফোন করছেন। পরিবারের সদস্যদেরও ফোন দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গেও নানা পরিচয়ে লোকজন যোগাযোগ করছে। সবার একই কথা_ ‘আসামিরা অনেক বিত্তশালী। সব জায়গায় টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মামলায় কিছু হবে না। তার চেয়ে সমঝোতা করে ফেলুন।’

এক তরুণী বলেন, অনেক ফোনে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। বাসার সামনে অপরিচিত লোকজন ঘোরাফেরা করে। কেউ কেউ ফোন দিয়ে খুব আন্তরিক আচরণ করেন। এর ফাঁকেই বিত্তশালী আসামিদের ভয়াবহতা তুলে ধরে মীমাংসা করে ফেলতে অনুরোধ করছেন। এমন অনুরোধে বুঝতে বাকি থাকে না এরা আসামিদেরই লোকজন। ওই তরুণী বলেন, সবকিছু মিলিয়ে তারা এখন ফোন ধরতেও আতঙ্কবোধ করেন। বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করার পর এখন তারা ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছেন।

নাঈম আশরাফের প্রকৃত পরিচয়  :

দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার দুই নম্বর আসামির তালিকায় নাঈম আশরাফের নাম থাকলেও তার প্রকৃত নাম হাসান মো. আবদুল হালিম। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের নামে নাঈম আশরাফ পরিচয় দেওয়া এই হালিম নানা অসামাজিক ও অপকর্মের হোতা। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গান্দাইল ইউনিয়নে। ঢাকায় সে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ আলীর ছেলে পরিচয়ে চলত। মূলত ওই চেয়ারম্যানের ছেলের নাম নাঈম আশরাফ।

বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন জানান, ধর্ষণ মামলায় দুই নম্বর আসামির নাম নাঈম আশরাফ উল্লেখ থাকলেও তার বাবার নাম অজ্ঞাত ছিল। ঠিকানা শুধু মিরপুর লেখা ছিল। তবে তদন্তে তার প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে আসে। হালিমের বাবা আমজাদ হোসেন এক সময় ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতেন। ক্ষেতমজুর হিসেবে মাঠেও কাজ করতেন। কিছু দিন আগে হালিম তার মা-বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যান। হালিম ঢাকায় দুটি বিয়ে করেছেন বলে গ্রামবাসী জানেন।

কাজীপুরের গান্দাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী বলেন, তিনি আবদুল হালিমের পুরো পরিবারকে চেনেন। সে অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। হালিম এলাকায় একজন ভণ্ড হিসেবে চিহ্নিত।

গত বছর তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা থেকে ফোন পান। তাকে বলা হয়, তার ছেলে ‘নাঈম আশরাফ’ এক শিল্পপতির মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়ে দেখেন তার ছেলে পরিচয়ধারী তারই এলাকার আমজাদের ছেলে আবদুল হালিম। এরপর ঢাকায় তিনি আবদুল হালিমের নানা অপকর্মের কথা জানতে পারেন।

কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে হালিমের লাগানো বিভিন্ন পোস্টার-ব্যানারও এলাকায় রয়েছে। ২০০৪ সালে গান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে হালিম। ওই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় স্কুলের শিক্ষকের পরিচয় দিয়ে রাজশাহী বোর্ড থেকে প্রশ্নপত্র এনে ফেঁসে যায় সে। এরপর বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করা অবস্থায় সিরাজগঞ্জ শহরের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে বিত্তশালী পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করে। পরিচয় জানার পর হালিমকে মারধর করে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেন তারা। হালিম অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ‘বাবা’ বলে পরিচয় দিত।

সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা বলেন, তার সাবেক স্বামীকে নষ্ট পথে নিয়েছে এই প্রতারক ‘নাঈম আশরাফ’।

নাঈম আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের গান্ধাইলে জানতে পেয়ে সিরাজগঞ্জে অবস্থানরত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ধর্ষককে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। বুধবার রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই ধর্ষক ভুয়া নাম ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে ভুয়া রাজনৈতিক পরিচয় দিচ্ছে। যেকোনো মূল্যে তাকে গ্রেফতারের জন্য সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছি। ধর্ষককে পাওয়া না গেলে মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য বলেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সূত্র : সমকাল
Print Friendly, PDF & Email

Related Posts