বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ নিম্নচাপের প্রভাবে দুই দিনের টানা বর্ষণে বিপর্যয় নেমে এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগের তিন জেলায়; পাহাড় ধসে হতাহত হয়েছেন বহু মানুষ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ তিন জেলায় ছয় সেনা সদস্যসহ ৬৬ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ১৯ জন এবং চন্দনাইশে ৪ জন, রাঙ্গামাটির সদরসহ কাপ্তাই, লংগদু ও কাউখালীতে ৩৭ জন এবং বান্দরবানের সদরে ৬ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে মারা যান দুই কর্মকর্তাসহ ছয় সেনা সদস্য। এসময় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তবে এখনও কয়েকজন মাটিচাপায় আটকে আছে বলে জানা গেছে। তাদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
তিন জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর এবং ইসলামপুর ইউনিয়নে পাহাড় ধসে ১৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন রাঙ্গুনিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামাল হোসেন । মঙ্গলবার ভোর ৪টায় চন্দনাইশের দুর্গম এলাকা দোপাছড়ি ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের শামুকছড়িতে পাহাড় ধসে ১ শিশু এবং ছনবনিয়ায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- শামুকছড়ির শিশু মাহিয়া(৩), ছনবনিয়ার ২নং ওয়ার্ডের উপজাতি এলাকার সিনসাও কেয়াংয়ের স্ত্রী মোকা ইয়ং কিয়াং (৫০), কেলাও অং কেয়াংয়ের কিশোরী কন্যা মেমো কেয়াং (১৩) ও ফেলাও কেয়াংয়ের শিশু কন্যা কেওচা কেয়াং (১০)। এসময় আহত হয়েছেন সানু কেয়াং (২১), শেলাও কেয়াং (২৭) নামে আরো ২ জন।
জানা গেছে, রোববার থেকে ওই এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে সোমবার রাত ২টার পর ভারী বৃষ্টি ও সঙ্গে বজ্রপাতসহ ঝড়ো হাওয়া হয়। এরপরই এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। প্রায় ২০/৩০টি উপজাতি পরিবার ওই এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বাপ-দাদার আমল থেকে বসবাস করে আসছে। বাকি পরিবারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তারা আতংকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছেন। স্থানীয় লোকজন স্বউদ্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, হাসপাতাল ও স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে প্রবল বর্ষণে বাড়িঘরে পাহাড়ের মাটিচাপায় রাঙ্গামাটি শহরের রিজার্ভবাজার, ভেদভেদী, শিমুলতলী, মোনঘর, রাঙ্গামাটি ও মানিকছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ২০ জন, কাউখালীর বেতবুনিয়ায় চার জন, ঘিলাছড়িতে তিন জন, কাশখালীতে তিন জন এবং কাপ্তাই রাইখালীর কারিগর পাড়ায় চার জন মারা গেছেন।
তাদের মধ্যে মানিকছড়িতে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি অপসারণের সময় ছয় সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়। তারা হলেন, মেজর মাহফুজ, ক্যাপ্টেন তানভীর আহমেদ, সিপাহী আজিজ, শাহীন, ল্যান্স কর্পোরেল আজিজ, সিপাহী মামুন। তারা রাঙ্গমাটি সেনা রিজিয়নে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েক সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাঙ্গামাটি এবং ঢাকায় ভর্তি করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে রুমা আক্তার (২৫), নুর আক্তার (৩), হাজেরা (৪০), সোনালি চাকমা (৩০), এক বছর বয়সী শিশু অমিয় কান্তি চাকমা, আইয়ুশ মল্লিক (২), চুমকি মল্লিক (২), লিটন মল্লিক (২৮), অজ্ঞাত (২২), মিন্টু ত্রিপুরা (৪৫), আবদুল আজিজ (৫৫), অজ্ঞাত (৩২), মিলি চাকমা (৫৫), ফেন্সি চাকমা (৪) এবং কাউখালীর যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন-ফাতেমা বেগম (৬০), মনির হোসেন (২৫), মো. ইসহাক (৩০), দবির হোসেন (৮৪), খোদেজা বেগম (৬৫), অজিদা খাতুন (৬৫), মংকাচিং মারমা (৫২), আশেমা মারমা (৩৭), শ্যামা মারমা (১২), ক্যাচাচিং মারমা (৭), কুলসুমা বেগম (৬০), বৈশাখী চাকমা (১০), লায়লা বেগমের (২৮) লাশ উদ্ধার করে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এদিকে কাপ্তাই রাইখালীর কারিগর পাড়ায় নিহত ৪ জনের নাম তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। এর আগের দিন সোমবার রাঙ্গামাটি শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় এক শিশু এবং কাপ্তাইয়ের নতুন বাজারে এক শিশু পাহাড়ের মাটি চাপায় মারা যায়। এছাড়া কর্ণফুলী নদীতে পড়ে ইকবাল নামের এক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন।
এদিকে সোমবার রাত থেকে রাঙ্গামাটি শহরের অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটির সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। এতে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে বিভিন্ন এলাকায় অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়েছে। এসময় আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে পাঁচজন। মঙ্গলবার ভোররাত পৌনে ৪টার দিকে জেলার পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড কালাঘাটা এলাকার ত্রিপুরা পাড়াসহ দুর্গম কয়েকটি এলাকায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে চার জনের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলো- শহরের আগাপাড়ার একই পরিবারের শুভ বড়ুয়া (৮), মিঠু বড়ুয়া (৬), লতা বড়ুয়া (৫) ও কালাঘাটা কবরস্থান এলাকার রেবি ত্রিপুরা (১৮)। এ ঘটনায় জাইল্লাপাড়ায় কামরুন্নাহার ও তার মেয়ে সুফিয়া (২০) নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন।
এছাড়া গুরুতর আহত অবস্থায় দুইজনকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলেন- পসান ত্রিপুরা ও বীর বাহাদুর ত্রিপুরা। সদর থানার ওসি মো. রফিক উল্লাহ এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে পাহাড় ধসে সেনা সদস্যসহ হতাহতের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে রাঙামাটি পৌঁছেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক। মঙ্গলবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থল পৌঁছান তিনি।