বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় ধ্বংসস্তূপ থেকে মঙ্গলবার ক্ষতবিক্ষত আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা। এ নিয়ে বিকেল পর্যন্ত ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩ জন হয়েছে।
এদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ১০ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘটনার পর থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মীরা বিধ্বস্ত কারখানার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে আরও হতাহতদের খোঁজে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ করছিলেন। এদিকে সোমবার রাতে কারখানায় বিস্ফোরিত বয়লারটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল বলে দাবি করেছে তদন্ত কমিটি।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান লিটন ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের ইন্সপেক্টর আবদুল খালেকসহ স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে বয়লারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানার একটি চারতলা ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয়তলার দুই পাশের দেয়াল, দরজা-জানালা ও মেশিনপত্র উড়ে যায় এবং দুমড়ে-মুচড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এবং বিস্ফোরিত বয়লারের টুকরোর আঘাতে কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছে এবং প্রায় অর্ধশত আহত হয়েছে। হতাহতদের সন্ধানে ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ‘রেস্কিউ অপারেশন’ শুরু করে। ঘটনার রাতে কারখানার ভেতরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ৯ জনের লাশ এবং আহত ৪৭ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে আহতদের মধ্যে আরও তিনজন মারা যায়। ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার সকালে ধ্বংসস্তূপ থেকে ক্ষতবিক্ষত আরও একজনের বিকৃত লাশ এবং বিকেলে আরও ৩ জনের লাশ উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা।
ঈদের ছুটির পর ওই পোশাক কারখানাটি মঙ্গলবার খোলার কথা ছিল। তবে সোমবার ডায়িং ইউনিটের বয়লার সেকশনটি চালু করা হয়। কারখানার চারতলা ভবনের নিচতলার ডায়িং ও ফিনিশিং সেকশনে এবং দ্বিতীয়তলার নিটিং সেশনে ৮০-৯০ জন শ্রমিক কাজ করছিল। এ ভবনসংলগ্ন একটি টিনশেডে ৭ টন ও ১০ টনের দুটি বয়লার ছিল। সোমবার এ বয়লার দুটি চালু করা হয়। সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে ৭ টনের বয়লারটি হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
স্থানীয়রা ও উদ্ধারকর্মীরা জানায়, এ ঘটনায় হতাহতদের প্রায় সবাই শ্রমিক। তবে কারখানার সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী কয়েক সাধারণ পথচারীও এ ঘটনায় আহত হয়। বিস্ফোরেণের ফলে এমা গার্মেন্টস, ইসলাম গ্রুপের ইউনিট-২, তাসনিয়া ও মৌরিশাস গার্মেন্টসসহ আশপাশের কারখানার ভবনগুলো কেঁপে ওঠে এবং দরজা-জানালার কাচ ভেঙ্গে যায়। বিস্ফোরিত বয়লার টুকরো টুকরো হয়ে অন্তত ৫০০ গজ দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। এক শ্রমিকের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ২০০ গজ দূরে এক ভবনের চালের ওপর পড়ে। এছাড়াও নিহত আরও কয়েক শ্রমিকের ছিন্নভিন্ন দেহ ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে।
ঘটনার পরপরই ওই এলাকায় বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়রা এগিয়ে এসে হতাহতদের উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, সাভার ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠাতে থাকে। খবর পেয়ে জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর, টঙ্গী ও সাভার ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলাম, পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, কারখানার চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ফারুক, ফায়ার সার্ভিস ও র্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গাজীপুরে বিস্ফোরিত বয়লারটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস কারখানায় সোমবার রাতে বিস্ফোরিত বয়লারটি ছিল মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল। বয়লারটি নবায়নের শেষ দিন ছিল গত ২৪ জুন। মঙ্গলবার দুপুরে বয়লার পরিদর্শক কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের গঠন করা আট সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, সাতটি কারণকে সামনে রেখে আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি। প্রধান বয়লার পরিদর্শক জানিয়েছেন যে, বয়লারটি নবায়নের শেষ তারিখ ছিল গত ২৪ জুন। তারপর বয়লারটি নবায়ন করা হয়নি।
নিহতদের পরিচয় ও লাশ হস্তান্তর
গাজীপুরে কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে বলে গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোরশেদ জানান। তারা হলেনÑ বিবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার কুন্তা গ্রামের মৃত সাগর আলী মীরের ছেলে কারখানার সহকারী প্রকৌশলী মজিবুর রহমান (৩৭), বগুড়া জেলার সোনাতলা থানার নামাজখালী হরিমালী গ্রামের শাহার আলীর ছেলে মাহবুবুর রহমান (২৩), চট্টগ্রামের মিরসরাই থানার বামনসুন্দর দারোগারহাট গ্রামের মৃত মোকছেদ আহমেদের ছেলে কারখানার বয়লার ইনচার্জ আবদুস সালাম (৫৫), চাঁদপুর সদরের মদনা বাছুরপুর গ্রামের বাচ্চু ছৈয়ালের ছেলে গিয়াস উদ্দিন (৩০), রাজবাড়ী গোয়ালন্দ থানার চরকাছনন্দ বরাট বাজার এলাকার মনিন্দ্র নাথ শীলের ছেলে বিপ্লব চন্দ্র শীল (৩৮), চট্টগ্রামের মিরসরাই থানার কাটাছড়া বঙ্গনূর জোড়ালগঞ্জ এলাকার লুৎফুল হকের ছেলে মনসুরুল হক (৩০), মাগুরার হরিশপুর থানার গোবরা গ্রামের আইয়ুব আলী সরদারের ছেলে ফায়ারম্যান আল আমিন (৩০), চট্টগ্রামের মোড়লগঞ্জ থানার ইছাখালী মাতবরহাট এলাকার নুরুল মোস্তফা চৌধুরীর ছেলে আরশাদ হোসেন চৌধুরী (৩৬), নওগাঁ জেলার চকরামপুর স্কুলপাড়া এলাকার মৃত আজিজুল ইসলামের ছেলে আমিরুল ইসলাম ও গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থানার মরিয়া গ্রামের লিয়াকত আলীর ছেলে সোলেমান মিয়া (৩০)। এদের মধ্যে ৯ জনের লাশ মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হস্তান্তর করেছে জেলা প্রশাসন। অপর নিহত সোলেমান মিয়ার লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে হস্তান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত ৩ জনের পরিচয় সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।