বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আগামী রোববার। সেদিন মামলার প্রধান আসামি শাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হবে।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন তা সবিস্তারে আদালতে বলেছেন শাফাত আহমেদ। আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত বলেন, ধর্ষণের ঘটনার পর ভয় পেয়ে তিনি তাঁর বন্ধু সাদমান সাকিফকে ফোন করেন। তাকে বলেন, তাঁর বিপদ হয়েছে। একই সময়ে শাফাতের আরেক বন্ধু নাঈম আশরাফ বাদীর বান্ধবীকে হোটেলের কক্ষে টেনে নিয়ে যান।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জন্মদিনের পার্টির কথা বলে গত ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন শাফাত আহমেদ ও তাঁর বন্ধু নাঈম আশরাফ। গত ৮ জুন শাফাত আহমেদ ও তাঁর বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। অপর তিনজন আসামি হলেন শাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ, গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও তাঁর দেহরক্ষী রহমত আলী। ঘটনার ৪০ দিন পর দুই তরুণী বনানী থানায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে তাঁদের হয়রানি করে পুলিশ। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে হইচই পড়ে যায়।
শাফাত আহমেদ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন গত ১৮ মে। পরে তিনি এই জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন। তাতে উল্লেখ করেন, স্বেচ্ছায় তিনি জবানবন্দি দেননি। ভয় ও চাপের মুখে দোষ স্বীকারে বাধ্য হয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। একইভাবে নাঈম আশরাফও আদালতে দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেন। তিনিও আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।
শাফাত আহমেদ জবানবন্দিতে বলেন, নাঈম আশরাফের সঙ্গে তাঁর রেইনট্রিতে ঘটনার দুই থেকে তিন মাস আগে পরিচয় হয়। সাদমান সাকিফের বন্ধু মামলার বাদী ও তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে পিকাসো রেস্টুরেন্টে গত ১৮ বা ১৯ মার্চ রাতে পরিচয় হয়। গত ২৮ মার্চ তাঁর জন্মদিন ছিল। তিনি বনানীর রেইনট্রিতে জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বন্ধু মাহির হারুনকে রুম বরাদ্দের জন্য ফোন করেন। মাহির হোটেলটির একজন পরিচালক। তিনি হোটেলের কর্মকর্তা ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললে তিনি ইকবালের মাধ্যমে একটি প্রেসিডেন্ট স্যুট এবং একটি ডিলাক্স রুম বুকিং দেন। গত ২৮ মার্চ বিকেল চারটায় নাঈম আশরাফ রেইনট্রিতে আসেন। পার্টির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ চার প্রকার মদ সংগ্রহ করে হোটেলে রাখেন নাঈম। সেদিন সন্ধ্যা সাতটার সময় তিনি হোটেলের রুমে গিয়ে নাঈমকে দেখেন। এরপর নাঈমের দুজন বান্ধবী আসেন। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে বাদী ও তাঁর বান্ধবী তাঁর গাড়িতে করে হোটেলে আসেন। কিছুক্ষণ পর বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও তাঁর এক বান্ধবী আসেন। নাঈম বাদীর বান্ধবীকে টেনে হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুটের বেডরুমে নিয়ে যান।
শাফাত জবানবন্দিতে বলেন, মদ খাওয়ার কারণে বাদীর শরীরে কোনো শক্তি ছিল না। এ সুযোগে তিনি তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। ঘরটা তখন অন্ধকার ছিল। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কলিং বেলের শব্দ পেয়ে তিনি হোটেল বয় রাজুর কাছ থেকে খাবার গ্রহণ করে দরজা বন্ধ করে দেন। খাবার ডাইনিং টেবিলে রেখে ঘরের লাইট জ্বালান। বাদী তখন উঠে দাঁড়ান। হতভম্ব হয়ে যান। তখন তাঁর কাছে মনে হয় তিনি তাঁর (বাদী) সঙ্গে যে কাজ করেছেন, তা বাদীর পছন্দ হয়নি। এরপর বাদী দরজা খুলে বের হয়ে যান। তাঁর (বাদী) চলে যাওয়ার আচরণটি স্বাভাবিক ছিল না।
শাফাত বলেন, ‘তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। তাঁর পিছু পিছু যাই। তিনি দ্রুতগতিতে ৭০১ নম্বর রুমে ঢুকে পড়েন। আমি তখন কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, আমি বাদীর সঙ্গে যে কাজ করেছি, এটা আমার বিপদের কারণ হতে পারে। আমি উপায় না দেখে সাকিফকে ফোনে বলি, আমার একটা বিপদ হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি হোটেলে আসো।’
বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার তাঁর কক্ষ থেকে বের হয়ে শাফাতকে জিজ্ঞাসা করেন কী হয়েছে? তখন শাফাত তাঁকে বলেন, তিনি বাদীর সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন। তিনি পিল দিচ্ছেন, তাঁকে যেন খাইয়ে দেন। এ কথা শোনার পর শাহরিয়ার চলে যান। শাফাত আহমেদ বলেন, ‘আমি ড্রাইভারকে বললে ড্রাইভার পিল নিয়ে আসে। এর মধ্যে এক ঘণ্টা পার হয়ে যায়। কিন্তু শাহরিয়ার কোনো ব্যবস্থা না করায় আমি নাঈমকে ঘটনা জানাই। তখন নাঈম শাহরিয়ারকে প্রেসিডেন্ট স্যুটে ডেকে নিয়ে মারপিট শুরু করেন। ইতিমধ্যে সেখানে উপস্থিত সাদমান সাকিফ ও ড্রাইভার বিল্লাল উপস্থিত হন। মারামারির একপর্যায়ে নাঈম বিল্লালকে মোবাইলে ভিডিও করতে বলে। নাঈম শাহরিয়ারকে বলে, ‘তুই ইয়াবা ব্যবসা করিস। বল আর কখনো ইয়াবা ব্যবসা করবি না। এসব ভিডিও করার সময় শাহরিয়ার কাঁদতে থাকে। এর মধ্যে নাঈম শাহরিয়ারের গাড়ির চাবি কেড়ে নেন।’
এ ঘটনা যখন চলতে থাকে, তখন মামলার বাদী তাঁর বন্ধু শাহরিয়ারকে মারতে নিষেধ করেন। ঠিক এ সময় বাদীর বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী কাঁদতে কাঁদতে আসেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘নাঈম আশরাফ তাঁকে জোর করে ধর্ষণ করেছেন। নাঈম সবাইকে ভয়ভীতি দেখান।’
শাফাত বলেন, নাঈম তখন তাঁকে বলেন, তিনি বাদীর সঙ্গে আবার সম্পর্ক স্থাপন করবেন। নাঈম আসতে গেলে তিনি বাধা দেন। সকাল আটটার সময় নাঈম শাহরিয়ারের গাড়ির চাবি দেন। নাঈম সবাইকে হুমকি দেন, রাতের ঘটনা কাউকে জানালে শাহরিয়ারের ভিডিও প্রকাশ করবেন। পরদিন বাদী মামলার আসামি সাকিফকে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জানান, ধর্ষণের ঘটনা বাদী মেনে নিতে পারছেন না। বাদী ব্যবস্থা নেবেন। তখন তিনি বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাদী ফোন, মেসেঞ্জার ও ফেসবুক ব্লক করে রাখায় তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি।
বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, শাফাত বাদীকে পিল খাওয়াইতে বলেন। পিল না খাওয়ানোয় নাঈম আমাকে চড় মারেন। নাঈম আমাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। পরে বাদী তাঁকে বলেন, শাফাত তাঁকে রেপ করেছেন। তাঁর বান্ধবীকে রেপ করেছেন নাঈম।
প্রথমআলো