জিন প্রযুক্তিতে রবি-১ পাট চাষে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ জিন প্রযুক্তিতে রবি-১ পাট চাষে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রবি-১ নামে পাটের একটি নতুন জাত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের চারটি গবেষণাকেন্দ্রের মাঠে ও কৃষকের জমিতে চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে। এর মধ্য দিয়ে পাটের নতুন যাত্রা শুরু হলো বলে মনে করা হচ্ছে। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের সাত বছরের মাথায় এই সাফল্যের প্রথম বাস্তব প্রয়োগ ঘটল।

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে উদ্ভাবিত ওই জাত সাধারণ তোষা পাটের জাত থেকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এর উচ্চতা সাধারণ পাটের চেয়ে ২০ সেন্টিমিটার বেশি। আঁশের পরিমাণও বেশি, ২০ শতাংশ। সাধারণ তোষা পাট ১২০ দিন পর কাটতে হয়। নতুন এই জাত ১০০ দিনে কাটা যাবে। ২০ দিন বেঁচে যাওয়ায় একই জমিতে আমন চাষে সুবিধা পাবেন কৃষক। সাধারণ পাটের আগা চিকন ও গোড়া মোটা হয়, নতুন এই জাতের আগা-গোড়া সমান। এর আঁশের উজ্জ্বলতা বেশি বলে জানিয়েছেন পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

সংস্থাটির মহাপরিচালক ও নতুন জাত উদ্ভাবনের নেতৃত্বদানকারী গবেষক দলের প্রধান মনজুরুল আলম বলেন, ‘প্রচলিত তোষা পাটের জিন কাঠামোয় সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে এই নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি তোষা পাটের চেয়ে মান ও গুণে ভালো। গত তিন বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমরা এ প্রমাণ পেয়েছি।’

মহাপরিচালক জানান, আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁরা এটি জাতীয় বীজ বোর্ডের কাছে অনুমোদনের জন্য দেবেন। প্রয়োজনীয় বীজ উৎপাদনের পর তা আগামী দু-এক বছরের মধ্যে সারা দেশের কৃষকদের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে।

গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার প্ল্যান্টসে এই নতুন জাত উদ্ভাবনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষ (আইপিও) কর্তৃক এর মেধাস্বত্বের প্রাথমিক অনুমোদন (কোড) পাওয়ার বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরেন।

ফরিদপুর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, ‘পাটের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা’ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী উদ্ভাবিত রবি-১ জাতের এ পাট শুধু ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের মানিকনগর ও চৌশালা গ্রামের তিন কৃষকের মাধ্যমে চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মানিকনগরের কৃষক লক্ষ্মণ সেনের ৪৮ শতাংশ, চৌশালা গ্রামের ছেকেন শেখের ৩৬, একই গ্রামের নইমুদ্দিনের ৩০ শতাংশসহ মোট ১ একর ১৪ শতাংশ জমিতে এ পাট রোপণ করা হয়েছে।

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী শাহ মো. তামিম কবির বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলক আবাদ করে দেখেছি, তোষা ও ভারতীয় পাটের চেয়ে রবি-১ পাটের ফলন বেশি। এক হেক্টর জমিতে তোষা পাটের গাছ হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৭২৭টি এবং ভারতীয় জাতের গাছ হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭২৭টি। আর রবি-১-এর গাছ হয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫৮টি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গাছের উচ্চতার দিকে থেকেও এগিয়ে রবি-১। গড়ে রবি-১ বীজের একটি গাছের উচ্চতা যেখানে ৩ দশমিক ৩০ মিটার, সেখানে তোষা ও ভারতীয় জাতের গাছের উচ্চতা যথাক্রমে ৩ দশমিক ১৫ ও ৩ দশমিক ১৪ মিটার। তিনি বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, রবি-১ পাট রোপণ করা হলে ফলন অন্য পাটের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি পাওয়া যাবে।’

প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম জানান, পাটের ফাইবার কোয়ালিটি ভালো হয় যদি আঁশে লিগনিনের পরিমাণ কম হয়। রবি-১ পাটে অন্য জাতের পাটের তুলনায় লিগনিনের পরিমাণ ২ শতাংশ কম হবে। এতে আঁশের মান ভালো হবে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের ৮৫ শতাংশ আসে তোষা জাত থেকে। আর তোষা জাতের জন্য যত বীজ দরকার হয়, তার ৮৫ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ভারত থেকে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার টন জেআরও-৫২৪ জাতের পাটবীজ আমদানি করতে হয়। কৃষক পর্যায়ে ওই বীজ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি হয়। রবি-১ জাতের পাটের বীজ কৃষক নিজেরা সংরক্ষণ করতে পারবেন। এতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

আশির দশকে দেশে প্রথম পাটের জিন সিকোয়েন্সিং বা জীবনরহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম। দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিজ্ঞান তখনো খুব একটা এগোয়নি বলে তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ২০১০ ও ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী তোষা ও দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন।

মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের নতুন এই জাত উদ্ভাবনের কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর মাকসুদুল আলমের মৃত্যুর পর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বর্তমান মহাপরিচালক মনজুরুল আলমের নেতৃত্বে নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ চলতে থাকে। সংস্থাটির নিজস্ব গবেষণাকেন্দ্রে দুই বছর পরীক্ষার পর এ বছর তা কৃষকের মাঠে চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts