বিডি মেট্রোনিউজ॥ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে যারা অস্বীকার করবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত ও অসম্মানজনক বক্তব্য রাখবে ও কার্যকলাপ করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ ব্যাপারে মুুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় খসড়া আইন প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে শিগগিরই তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। এতে অপরাধীদের সশ্রম কারাদন্ডের বিধান থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী খ্যাতিমান বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক মিডিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে হানাদার পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের তালিকা প্রস্তুতের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারা তালিকা প্রণয়ন করবে। স্থানীয়ভাবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে যারা প্রকৃত রাজাকার, আল বদর, আল শাসম এ জড়িত ছিল তাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তাদের প্রণীত তালিকা যথাযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি করে কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে।
মন্ত্রী জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সারাদেশে রাজাকার, আল বদর, আল শাসম এর সদস্যদের থানা ওয়ারি তালিকা ছিল। ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও তা মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উধাও হয়ে যায়। সন্দেহ করা হচ্ছে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গায়ের করে দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ. ক. ম. মোজ্জামেল বলেন, পাক হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শাসম এর সদস্যদের মধ্যে যারা অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, এসব কাজে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তাদের শাস্তি বিধান করা হবে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা সম্পর্কে মন্ত্রী জানান, এ সংখ্যা বর্তমানে ১ লাখ ৯০ হাজার। বহু আবেদন পড়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর এ সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারে দাঁড়াতে পারে। দুঃখ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, জোট সরকারের সময় ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয়া হয়। মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর এদের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার সনদ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে এ সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি হবে না। এই প্রক্রিয়ায় কোনরকম দলীয় সংকীর্ণতা, হীনতা স্থান দেয়া হয়নি।
৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জীবিত মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রশ্নহীন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি করে তাদের সামনে সন্দেহভাজন সনদপ্রাপ্তদের ডেকে সরেজমিন তদন্ত করে, তথ্য প্রমাণ যাচাই করেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সনাক্ত করা হয়।
মন্ত্রী বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও কয়েক হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দেয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে। এসব সনদ বাতিল করা হবে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ পর্যায়ে তা সম্ভব হচ্ছে না।
মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল জানান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৫ হাজার সদস্যকে স্বীকৃতিপত্র, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর যুক্ত সনদ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি যুক্ত ক্রেস্ট প্রদান করা হবে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর মাইন মুক্ত করে নিরাপদ জাহাজ চলাচলের উপযোগী রাখার কাজ করতে গিয়ে আত্মত্যাগকারী রাশিয়ার ৫ জন নাবিককেও এই মরনোত্তর সম্মান দেয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানীভাতা চলতি জানুয়ারি মাস থেকেই ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, আগামী অর্থ বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঈদে দুটি ঈদ বোনাসও পাবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খরচে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হবে। ইউনিয়ন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা, শহরাঞ্চল ও মহানগরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হবে। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে তাদের আইডি কার্ড দেয়া হবে। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব সাংবাদিক, সাহিত্যিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, কলাকুশলী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্যাম্পে ক্যাম্পে সেবাদানকারি ডাক্তার, নাসর্, খেলোয়াড়, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হবে।
বিসিএস পরীক্ষায় ২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ১০০ নম্বরের প্রশ্ন থাকবে। শিল্পকলা, ক্রীড়া সংস্থাসহ সমাজ উন্নয়নমূলক সকল কমিটি ও স্থানীয় সরকারের সকল কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ত করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচির উল্লেখ করে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল আরো বলেন, এ পর্যন্ত ৩০০ উপজেলা কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ৩০ টির কাজ চলমান। ৫০ টি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হয়েছে। ১৪টির কাজ চলমান। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বছর ১০ হাজার বাসস্থান নির্মাণের কাজ চলছে। সম্মুখ সমরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর ও যুদ্ধের স্থান, বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ এবং একই ডিজাইনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ চলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, যুদ্ধাপরাধীদের নৃশংসতা, মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড তুলে ধরা হবে।
একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে স্বাধীনতাকামী লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সম্মান, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এই ঘোষণা দেয়ার পর সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল হয়ে উঠে।
ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করা, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯ মার্চ বাঙালি ছাত্র-শ্রমিক-জনতা জয়দেবপুর পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকরা তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিপাগল ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সাথে শরিক হন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। মুক্তিকামী বাঙালি ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে সংগঠিত করে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলার মরনজয়ী লড়াইয়ে যে ক‘জন অকুতোভয় তরুন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আজকের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল ছিলেন তাদের অন্যতম।
মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর কক্ষ থাকে মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ভীড়ে ঠাসা। বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী মোজাম্মেলের মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। প্রত্যেকের সাথেই কথা বলছেন, তাদের সমস্যার কথা শুনছেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। অবাক করার মতো, নির্বাচনী এলাকাসহ গাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণের মন্ত্রণালয়ে আসা নিয়ন্ত্রিত। মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গাজীপুরবাসীর জন্য উন্মুক্ত। বাসভবনে প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত তিনি গাজীপুরবাসীর সমস্যার কথা শোনেন।