বিশেষ প্রতিনিধি: নিউইয়র্কে লিটল ম্যাগাজিন ‘পঞ্চায়েত-এর পঞ্চম সংখ্যার পাঠোন্মোচন, আলোচনা এবং অ-রচিত (এক কবি পাঠ করেন অন্য কবির রচিত কবিতা) কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান সুন্দর এবং সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি ২০২০ রবিবার নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের একটি মিলনায়তনে নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘পঞ্চায়েত’ এর এই অনুষ্ঠান।
পঞ্চায়েত পঞ্চম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন- বাঙালি কমিউনিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ সর্বজন শ্রদ্ধেয় বক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা জনাব তোফায়েল আহমদ চৌধুরী। তাঁর সাথে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ‘পঞ্চায়েত পরিবার’ ছাড়াও প্রথম আলোর আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী , প্রফেসর আমিনুল হক চুন্নু, নাট্যজন এজাজ আলম, পর্যটক সাইদুর রহমান লিংকনসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
কবি হাবিব ফয়েজির সঞ্চলনায় আলোচনাপর্বে অংশগ্রণ করেন যথাক্রমে- কবি ফারুক ফয়সল, লেখক এবি এম সালেহ উদ্দিন ও কবি ফকির ইলিয়াস।
‘লিটলম্যাগের ইতিহাস এবং সাহিত্যে এর প্রভাব’ বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনায় ফারুক ফয়সল কথায় উঠে আসে – “ওরা বড়ো স্বল্পায়ু। ওরা জন্ম নেয় মরে যাওয়ার জন্য”। প্রাণ না থাকলেও লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে ইংরেজিতে কথাটি প্রচলিত। ফেলিক্স পোলাক, অধ্যাপক মার্ক ওয়ালসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে বলেছেন- একে ঠিক সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বর্ণনা করে বলার চেয়ে দেখে বোঝা সহজ।
কারো কারো অভিমত- অনেক ছোট্ট পরিসরে থেকেও পুরো জাতি বা বাইরের বিশ্বকে খুঁটিয়ে দেখার অভিপ্রায় লিটল ম্যাগাজিনের।’কণ্ঠস্বর’ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুলাহ আবু সায়ীদ দৈনিক ইত্তেফাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- লিটল ম্যাগাজিন আর ব্যবসা একসাথে যায় না।
আমরা লিটল ম্যাগের কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় লক্ষ্য করে এর স্বরূপ চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়ে থাকি।সেগুলো হচ্ছে- প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থি, প্রতিষ্ঠান বিরোধী, সীমিত প্রচার সংখ্যা এবং একটি নির্দিষ্ট মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে একজন বা একদল সমমনা লেখকদের চিন্তার প্রতিফলনের নিমিত্তে নিজেদের উদ্যোগ ও চেষ্টায় পত্রিকায় নিজেদের কথা বলা।
প্রাচ্যে লিটল ম্যাগ প্রকাশনা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ লিটল ম্যাগের মাধ্যমেই বঙ্গসাহিত্যের উত্তরণের কাঠামোয় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য সাহিত্যের সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে।
অর্থনীতি আর প্রযুক্তির মেরুকরণে হারিয়ে গিয়েছে অনেক লিটল ম্যাগাজিন। মনে হতে পারে আর্থিক কারণেই এসব পত্রিকা দীর্ঘজীবী হতে পারে না, কিন্তু সেটাই সবটুকু নয়। স্বল্পায়ু হওয়াই এদের ধর্ম। বিশেষ কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে, বিশেষ কোনও কাজ নিয়ে এরা আসে, কাজ সম্পন্ন করে বিদায় নেয়। তবে ছাপ রেখে যায়, তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায় কালের যাত্রায়, তাদের কথা রয়ে যায় কোথাও না কোথাও আমাদের সাহিত্যের রূপরেখা তৈরিতে নব নব ধারায়, নতুন ভাষায়, নতুন কথায়।
‘পঞ্চায়েত’ পঞ্চম সংখ্যার পাঠোদ্ধার করে সুন্দর এবং সাবলীল উপস্থাপন করেন এবিএম সালেহ উদ্দিন। তিনি বলেন – ‘শুধু নর্থ আমেরিকায় বসবাসরত লেখকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত লিটল ম্যাগ পঞ্চায়েত পুরোটাই পড়েছি। এতে আছে ভালো ভালো প্রবন্ধ, মন ভালো করার মতো গল্প, সমকালীন ভাবনার কবিতা, ছন্দের দোলায় দোলে ওঠার মতো মজার মজার ছড়া, ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরে দেখার ভ্রমণ কাহিনি এবং সমৃদ্ধ সমালোচনা। সব মিলিয়ে এটি একটি নান্দনিক সফল লিটল ম্যাগাজিন। এর লেখা পড়ে কেউ ঠকবেন না।’ তিনি ধন্যবাদ জানান পঞ্চায়েত সংশ্লিষ্টদের।
“উত্তর আমেরিকায় বাংলা সাহিত্যচর্চা” বিষয়ে কথা বলেন কবি ফকির ইলিয়াস। তিনি বলেন এখানে আশানুরূপ সাহিত্যচর্চা হচ্ছে না। যা বেরিয়ে আসার কথা তা আসছে না। তিনি বলেন- আমি অনেকটাই নিরাশ। তার মতে যারা চাইলে ভালো কিছু করতে পারতেন তারা এগিয়ে আসছেন না, সময় দিচ্ছেন না, কাজ কিংবা অন্য কোনও অজুহাত দিয়ে সাহিত্য থেকে দূরে অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন।একজন লেখককে দায় থেকেও লিখতে হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি লেখকের কলম না চলে তবে আপনি কিসের লেখক? আপনাকে লেখক দাবি করলে মাঠে ময়দানে থাকতে হবে। শুধু বইমেলা আসলেই প্রতিবছর ৩/৪ টা বই বের করলেন আর ঘরে স্তুপ সাজালেন তাতেই কী আপনি লেখক হয়ে গেলেন? না আপনার অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আছে। তাছাড়া আপনাকে পড়তে হবে, জানতে হবে, অধ্যবসায় করতে হবে। তারপর না হয় লিখতে আসুন। পরিশেষে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এখন হচ্ছে না বলে যে আগামীতে হবে না তা কিন্তু নয়, যেমন ‘পঞ্চায়েত’ এগিয়ে এসেছে। পঞ্চায়েতের এ উদ্যোগ নিশ্চয়ই আশা জাগানিয়া এবং প্রসংশার দাবিদার।
মাসুম আহমদের পরিচালনায় অ-রচিত (অন্যের রচিত কবিতা) কবিতা পাঠ করেন- সোনিয়া কাদির, ফারুক ফয়সল, মোখলেসুর রহমান, মনজুর কাদের, জুলি রহমান,আহমেদ ছহুল, মিশুক সেলিম, ফারহানা ইলিয়াস তুলি, রওশন হাসান, মেহের চোধুরী, কামরুন নাহার রীতা, জান্নাতুল আরা, তাহমিনা শহিদ, হাবিব ফয়েজি, মাকসুদা আহমদ, সালেহীন সাজু, নাসির উল্লাহ, আব্দুস শহিদ, স্বপ্ন কুমার, পল্লব সরকার, কবিতা হোসেইন, বেনজির শিকদার, তাহরিনা পারভিন প্রীতি, পলি শাহিনা, শাম্মি আক্তার হ্যাপি, সারওয়ার চৌধুরী, বদরুজ্জামান রুহেল প্রমুখ।
সচরাচর সাহিত্য অনুষ্ঠানে বাচিক শিল্পীরা অন্যের কবিতা আবৃত্তি করলেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবিরা নিজেরাই নিজেদের কবিতা পাঠ করে থাকেন, আর পঞ্চায়েত সেখানেই ঘটিয়েছে ব্যতিক্রম। অনুষ্ঠানে সব কবিতাই পঠিত হয়েছে একে-অপরের। অনেকেই চমকিত হয়েছেন। পাঠকের চোখেমুখে শংকাভাব থাকলেও কবির মুখে ছিল কিছু একটা প্রাপ্তির উল্লাস। অন্যের কণ্ঠে নিজের কবিতা, অনেকের জীবনে এটা প্রথম। যেমন ছাপার অক্ষরে প্রথম নিজের কবিতা দেখার মতোই।
পিনপতন নীরবতা এবং গুরুগম্ভীর পরিবেশে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করেন সবাই। তারপর আপ্যায়ন পর্ব শেষে অনুষ্ঠানের বর্ধিত অংশে লেখক এবং সাংবাদিক শামিম আহমেদ চিনি’র ক্ষতিকর দিক নিয়ে একটা স্লাইড সো করেন। তারপর গান পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন শারমিন তানিয়া, তাহমিনা শহিদ এবং কামরুজ্জামান ফয়েজ। হাসি আর হাততালিতে পুরো হল সরগরম করে তোলেন শহিদ উদ্দিন তার কৌতুক এবং রসাত্মক কথাবার্তায়।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- আহমদ মাযহার, এন মজুমদার, আহবাব চৌধুরী খোকন,জলি, ডলি, লুসি, জীবনসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানে আগত সকলকে পঞ্চায়েত এর পক্ষ থেকে- হাবিব ফয়েজি এবং মাসুম আহমদ অনেক অনেক ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।