ফকির ইলিয়াস এর একগুচ্ছ কবিতা

কবিতার গ্রহগ্রন্থ

কিছু কি বলতে চেয়েছিলে সেই রাতে
অথবা চেয়েছিলে, ভেসে যেতে ঝড়ের আঘাতে
পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঢেউ যেমন অতিক্রম করে নদী
এবং আবার ফিরবে বলে বৃহস্পতিবার অবধি
একাকার মেঘের ভেলায় তুমুল চিহ্নগুলো
দাঁড়িয়েছিল পাশে বনের বিনীত ফুলও
এমন অনেক কথাই আজ আর খাতায় লেখা নাই
কবিতার গ্রহ সাজিয়ে সে সড়কে হাঁটে প্রান্তিক কানাই!

 

জলনির্মাণের কাল

আমরা সানন্দে বরণ করেছিলাম,
জলনির্মাণের কাল।আমাদের সামনে
খোলা ছিল একটি বৃহৎ তাঁঁবু। যে তাঁবুতে
বাস করতো কিছু সুখী মানুষ, যে ঘাসের
গালিচায় খেলা করতো তাদের শিশুরা।

এই শিশুরাই একদিন ভীত হয়ে তাকালো
আকাশের দিকে।এই আকাশ তাদের দেখালো
ভিন্ন বজ্রপাত। শিশুরা পিতৃহারা হলো,
তারা হারালো মা’কে ও।
তারপর তারা হাতে তুলে নিল কয়েকটি পাথর।

বিশ্বের রক্তশাসকদের বালাখানায় আমরা যে
শ্বেতপাথর দেখি-
সেগুলো সেই রক্তেই একদিন রঞ্জিত ছিল,
ভূমধ্যসাগরে আমরা দেখি উপুড় হয়ে থাকা
যে কিশোরীর শবদেহ,
তার কাগজের নৌকোটি ডুবিয়ে দিয়েছিল
পাচারকারী বেনিয়া,
মানুষের চোখ কিংবা কিডনি বিক্রি করে
এই লুটেরা’রাই জয়ধ্বনি দিয়েছিল ‘মানবতার’!

আমি আমার কবিতায় ওদের সনাক্ত করে
যাচ্ছি। আমি প্রতিবাদ করে যাচ্ছি-
সকল গণহত্যার, সকল অপহরণের,
সকল অপশাসনের-
এবং বলে যাচ্ছি, সমবেত হও হে মানুষ,
ঐক্যের লাঙল দাবিয়ে আবার উদ্ধার হোক
এই ভূমি,
একটি নতুন সূর্যের জন্য তৈরি হচ্ছে যে বিশ্ব
দাঁড়াও তার পাশে। শির উঁচু করে বলো-
মানুষের চেয়ে বড় শক্তিশালী কেউ নেই,
কিছু নেই, কিছু নেই ।

অস্ট্রেলিয়া

আকাশে আকাশে মহড়া দিচ্ছে যুদ্ধবিমান।
টাইম স্কোয়ারে হাজারও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে
আমিও বলে এসেছি, যুদ্ধ নয় – শান্তি চাই
বলেছি, এই শীতার্ত দুপুরে যে মার্কিনী শিশু
ব্যানার হাতে এখানে এসেছে তার কথা পড়ুন
মাননীয় প্রেসিডেন্ট! বুঝতে চেষ্টা করুন
তার চোখের ভাষা।

যারা বিশ্বনীতির সর্দারি করেন, তারা আমার
মতো নিরীহ কবি’র কথা শুনবেন না জানি,
তবু আমি আমার চোখজোড়া’ কে সাক্ষী রেখে
সনাক্ত করি নিজের অশ্রু।
সিরিয়া,ইয়ামেন কিংবা কাশ্মীর থেকে-
সরিয়ে নিতে চাই দৃষ্টি!
অথবা ভারতের গ্রামে গ্রামে যারা হাত তুলে
করছেন রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ-
তাকাতে চাই না তাদের দিকেও!
কী হবে তাকিয়ে আর!

কাঁদি,কেঁপে উঠি। অষ্ট্রেলিয়ার ঘন বনাঞ্চলে
দীর্ঘ দাবদাহে পুড়ে ছাই হয়ে আছে যে প্রাণীগুলো
সেই ছবি দেখে আঁতকে উঠি!
যে উদ্ধারকারী পুড়ন্ত ক্যাঙ্গারুর গলায় ধরে
কাঁঁদছেন, আমি পরখ করতে চেষ্টা করি
তার মুখ!

কাঁদি আর ভাবি…
যে সভ্যতা প্রাণীকূলকে বাঁচাতে পারে না-
যে প্রযুক্তি নেভাতে পারে না অগ্নিগিরির আগুন
তার কাছে মানুষ কতটা নিরাপদ!
তার কাছে আমি কেন চাইবো
মানবসমাজের আমূল নিরাপত্তা!

 

মুখোশের মমিগুলো

লুকিয়ে রেখেছিলে অনেকগুলো মারণাস্ত্র,
আস্তিনে বিষ, বর্শাফলা,বিবাদ-
আর অসুখের অগণিত পসরা
মানুষকে ফাঁসাবে বলে বিক্রি করেছিলে
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।

কথায় সক্রেটিসের বাণী উচ্চারণ করে
মানুষকে করেছিলে মোহগ্রস্ত। অথচ প্রস্থে
ছিলে ক্ষুদ্র ধনুক আর উচ্চতায় বনসাই!
কেউ জানতো না তুমি কে,
কেউ জানতো না তোমার কচ্ছপের আদল,
তোমার বক্রধ্বনি,তোমার ভেতরের দানবচিত্র-
যে দানব একাত্তরের একদিনে লণ্ডভণ্ড করেছিল
আমাদের শান্ত জনপদ।

দশকের পর দশক তুমি ছিলে আততায়ী,
অথচ তুমি জানতে-
ঘাতককে সনাক্ত করার পর মানুষ ছুঁড়ে দেয়
এক দলা ঘৃণা। ফিরেও তাকায় না আর।

আমি এক অনাথ বাউল,চিরকাল হাতের
একতারা অথবা কলমকেই ধরেছি শক্তি দিয়ে-
আর চিহ্নায়ন করেছি আদি মুখোশের মমিগুলো
যে মুখোশ একদিন ঢুকে পড়েছিল
অনেকের বুক পকেটে।

মানুষ দাঁড়াবেই
আর পরাজিত হবে দানব
প্রজন্ম এগোবেই
আর পিছু হটবে আততায়ী
যারা চুপ করে থাকে, যারা সাম্প্রদায়িক
সহিংসতার প্রতিবাদ করে না,
আমি তাদের আততায়ী আগেও বলেছি-
এখনও বলি,
এই যে উপেক্ষা আর অবজ্ঞার পাহাড়
ঘিরে ধরছে চারিদিক,
তা কি প্রকৃতির সমুচিত জবাব নয়!

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts