শিউল মনজুর
উৎস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মিলু শামস এর মলাটবন্দী ২৯টি কবিতার বই, দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো পাঠ করে কখনো আবেগ আপ্লুত, কখনো মুগ্ধ, কখনো শোকাচ্ছন্ন হয়েছি আবার কখনো কবির বুনন শিল্পে বিমোহিত হয়ে কোনো কোনো কবিতা একাধিকবার পাঠ করেছি।
কবি মিলু শামস শৈশব কৈশোর থেকেই লিখছেন। পেশায় সাংবাদিক এই কবির ইতোপূর্বে দু‘টি প্রবন্ধের বই এবং একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলির নাম হচ্ছে, আতঙ্কের পৃথিবীতে এক চক্কর (প্রবন্ধ), আবদ্ধ সময় এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা (প্রবন্ধ) এবং নিরুপায় বৃত্ত (কবিতা)।
২০২০ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত তার এই বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। অফসেট পেপারে ঝকঝকে মুদ্রিত এই কবিতা বইটিতে মানুষের জীবন যাপনের সামাজিক চিত্র, ঐতিহ্যের সোনালি সময়, একাত্তরের আনন্দ-বেদনার গল্প, সর্বোপরি নর-নারীর প্রেম ভালোবাসা, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা ও মানবিক চাওয়া পাওয়ার নানাচিত্র উঠে এসেছে।
বইটির ৩৩ পৃষ্টায় মুদ্রিত কবিতার শিরোনাম হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। এই কবিতাটির অংশ বিশেষ এরকম-
মেরুদণ্ড গুলো হ্যাঙ্গারে ঝুলতে দেখে
শিশুরা চিৎকার দিয়ে ওঠে
ওরা সরীসৃপ হতে চায় না
অথচ লন্ড্রির হ্যাঙ্গার থেকে
কেউই ওগুলো নামিয়ে
বাড়িমুখো হয় না।
চমৎকার উচ্চারণ এবং একটি বিষয়কে প্রতীকী ভাবনায় কবির উপস্থাপন ভঙ্গি আমাকে তাড়িত করে। কবির নির্মাণ নিপুণতায় পুলকিত হয়ে উঠি।
বইটির ৩৫ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত আরেকটি কবিতার শিরোনাম, বাড়ি। কবিতাটির অংশ বিশেষ এ রকম-
এই প্রথম বাড়ির সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়-
ইট কাঠ মার্বেলের
কারুকাজ নয়
বাড়ি অর্থ বসতি
কিছু মানুষের স্বপ্ন আর
মমতার সীমানা,
অঙ্কুরোদগম বীজের সজীবতা নিয়ে
বাড়ি বেঁচে থাকে
গৃহীর কল্যাণ ছোঁয়ায়।
বাড়ি মানেই নাড়ির টান, বাড়ি মানেই স্বপ্ন অম্লান। বাড়ি নিয়ে কবির ভিন্নমাত্রিক ভাবনা আমাকেও ছুঁয়ে যায়। মনে করি পাঠক মনে কবিতাটি ক্ষণিকের জন্যে হলেও দোলা দেবে।
মিলু শামসের কবিতায় যেমন বিষয় বৈচিত্র্য আছে তেমনি অসংখ্য কবিতায় অলংকার উপমাও দৃশ্যমান। তাই কবিতার নিমগ্ন কিংবা নিভৃতচারী পাঠকেরা কবিতাগুলো পাঠ করে আনন্দই পাবেন। উপমা অলংকারে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে নদীর টলটলে স্বচ্ছ জলের মতো মায়াবী হয়ে উঠেছে এমন কয়েকটি কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করছি-
এক. তুমি আর আমি হই / হলুদ জোনাকি। (পৃষ্ঠা-১১)
দুই. ঘাসের ডগায় বোনা / মায়াবী পৃথিবীর গান। (পৃষ্ঠা-১৪)
তিন. অথচ স্বচ্ছ চায়ের কাপে / নিস্তেজ গ্রিন টি‘র বিষণ্নতা। (পৃষ্ঠা-১৫)
চার. তুমি আমার সুর-জাগানিয়া / মথুরা ও বৃন্দাবন / নিভৃত মন্দিরা / অবিরাম বেজে যাও বলে / এই বেঁচে থাকা। (পৃষ্ঠা-২২)
পাঁচ. মূক ও বধিরদের নিয়ে / গাড়ি এসে থামলো / সূর্যোদয়ের পেছন দিকে। (পৃষ্ঠা-৩০)
মিলু শামসের কবিতা মিলুর মতই, তার ভাবনার মতই। ক্ষুদ্র অভিজ্ঞান থেকে বলতে পারি, দীর্ঘায়িত দুঃখগুলোর কবিতা পড়তে পড়তে কবির ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করতে করতে পাঠকের মনে হবে, কাব্যের অনন্য এক সুন্দর ভুবনে বিচরণ করছেন। আশা করি, কবি তার কাব্য শৈলী দিয়ে আমাদেরকে আগামিতেও মুগ্ধ করবেন।
#
শিউল মনজুর। কবি ও কথাশিল্পী।
মেরীল্যান্ড, আমেরিকা। ফোন; ১ ৩০১ ৫৪৯ ৬৯০৪।