জোছনার স্রোতে ॥ দীলতাজ রহমান এর গল্প

বাড়ি বদল করে চামেলীবাগের বহুতল বাড়ির পাঁচতলার এই ফ্ল্যাটটিতে আসার পর থেকে আমার ছোটমা’কে দেখি কাজের ফাঁক গলিয়ে প্রায়ই রান্নাঘরের জানালায় তাকিয়ে থাকে। ছোটমা আমারই সমবয়সী, যেটুকু বড় তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবু তাকে মা বলে ডাকতে হবে বলে তার কাছে এতদিন সহজ হতে পারিনি এবং কোনো সম্বোধনও করিনি। ছোটমা মায়ের ভূমিকা ফলাতে আসলেই ভাবতাম, অভাবি সব মানুষেরাই এতটা লাজ-লজ্জাহীন হয় নাকি? পারে কী করে উপযাচকের মতো এতটা মুরব্বিয়ানা ফলাতে!
পাকা গিন্নির মতো কোনো কাজে ফাঁকি নেই। এমনকি গভীর রাতে একগ্লাস দুধ আমার শুয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হাতে ধরিয়ে দিতেও সে ভোলে না। আমার মায়ের মতো অকৃত্রিম এক করুণ দৃষ্টি তখন ঝরতে দেখি তার দৃষ্টিতে। তার এই অস্বাভাবিকত্বটাই আমি মানতে পারি না। কেন তার সবকিছু এতটা নিখুঁত হয়। আমার ছোটভাই ফেরদৌস অযথা তখন বিগড়ায়, ছোট মা তাতে কখনো চটে না। সন্তান পেটে না ধরেও লালন না করেও শুধু দেখা আচরণে কী করে সে মা হয়ে উঠলো? অথচ জন্ম দিয়েও তো মা হতে পারে না কতজন। ও কি সবাইকে সুখী রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঢুকেছে এ সংসারে! কিন্তু ও নিজের সুখের কথা কেন ভাবে না?
লুকিয়ে ছোটমা কাকে এভাবে দেখে। একবার পা টিপে টিপে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, ধরা পড়ে কেমন জব্দ হবে। কিন্তু না, সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়লো না। দৃষ্টির সীমানায় যতগুলো বাড়ি আছে তার কোনো জানালা দরজায় অথবা কোনো বারান্দায় কোনো যুবক দূরের কথা কোনো শিশুটিও নজরেও পড়লো না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শুনলাম কেমন উদাস কণ্ঠে ছোট মা বলছে, দেখ পারুল ঐ যে, কোনো বাড়ির ছাদে বোধহয় পানি জমে আছে। দেখে মনে হয় ওটা যেন গভীর কোনো পুকুর। তাইতো ওটা দেখে আমার এত ভালো লাগে। জানিস ওটা দেখলে আমার আমাদের গ্রামের কথা মনে পড়ে। আমাদের বাড়ির চারপাশে যে কত যে পুকুর। ছোটবেলায় দল বেঁধে যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
একটা রেখে আরেকটায়। বড় হয়ে উঠলে অবশ্য আর তা পারিনি। তবু সে সব কথা মনে পড়ে এত ভালো লাগে… কথাগুলো বলে শেষ না হতেই ছোটমা আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। আর তাতে আমার মুখখানা অপরাধবোধে রক্তশূন্য হয়ে আসছে। কী যা-তা ভাবছিলাম আমি। থতমত খেয়ে শুকনো কণ্ঠে বলতে লাগলাম, ওটা বোধহয় পুকুরই। ‘দূর বোকা মেয়ে’ এত উপর থেকে এতে বড় বড় সব বাড়ি ছাপিয়ে নিচে পড়ে থাকা অতো দূরের কোনো পুকুর বুঝি এভাবে দেখা যেত?’ ছোটমার চোখে পলক পড়ে না দৃষ্টি আরো বিস্ফোরিত হয়ে থাকে সেদিকে।
যাই হোক, পুকুর কেন সমুদ্রও আমাকে অত টানে না। ব্যবসায়ী মানুষ আমার বাবা। সারা জীবন দেখলাম নেশা বলতে শুধু তার টাকার পরিমাণ বাড়ানো। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আমার মা দু’হাতে সেই টাকা ভাঙার স্বাধীনতা আর আমাদের দু’টি ভাইবোনকে নিয়ে মেতে ছিলেন। সুখের সবটুকু আমেজ নিয়ে তবু মা অকালে গত হলেন, বিনা নোটিশে একরকম বলা যায়। এমনতর পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা কোনো মানুষের কাছে যে কোনো নন্দনতত্ত্বের চর্চা বাহুল্য মনে হবে বৈকি। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান, স্বল্পভাষী মানুষ বাবা অন্যের বাড়িতে এসে পড়ে থাকা মানুষের অভিভাবকত্ব বেশিদিন বরদাস্ত করতে পারলেন না বলে, কটু শোনাবে জেনেও স্ত্রীর মৃত্যুর দু’মাস না যেতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবং কদিন না যেতেই হৈ হৈ করে বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের পাত্রীর সন্ধানও আনতে লেগেছিলেন। পঞ্চাশোর্ধ জামাইয়ের এমন নিষ্ঠুর-হ্যাংলা আচরণ দেখে আমার নানি শংকিত হলেন। তবু দূরদর্শীর মতো তিনি এগিয়েও যাচ্ছিলেন তার চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের এক বিধবা ভাগ্নে বৌয়ের জন্য। বাবারও অমত ছিল না তাতে। কিন্তু আমার বাবার বড় বোন অর্থাৎ আমাদের বড় ফুপু তার শ্বশুর বাড়ির কাছের বিশ-একুশ বছরের একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে এবং মেয়েটির সৌন্দর্য বর্ণনা করে বাবাকে মুগ্ধ করে পাকা কথা নিয়ে তবেই সেদিন গিয়েছিলেন, শিগগিরই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি রেখে।
বড় ফুপুআম্মা করিৎকর্মা মানুষ। কথাও বলেন সব কাজের কাজের। কিন্তু সে সব কথার সঙ্গে এমন সত্যগুলো প্রকাশ করে ফেলেন যে, তাতে তার নিজের অথবা যাকে নিয়ে বলছেন তার একান্ত গলদটুকুও শ্রোতা-দর্শকদের কাছে প্রকটিত হয়ে ওঠে।
আমার বাবার সঙ্গে ছোটমায়ের বিয়ের আগেই আমাদের জানা হয়ে গেছে গরিব ঘর হলেও বড় বাড়ি। শিক্ষা-দীক্ষা আছে। শিল্প-সাহিত্যের চর্চাও হয় ও বাড়িতে। চাচাতো মামাতো ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বড় সাংবাদিক। ছোটমায়ের ভাইগুলোও মেধাবী। স্কুল-কলেজে পড়ছে সবাই। ছোটমা এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু যাওয়া-আসার খরচ দিয়ে দূরের কলেজে মেয়েকে পড়ানোর সঙ্গতি তার বাবার ছিলো না।
শিল্প-সাহিত্যের চর্চা যে বাড়িতে হয়, সে বাড়িতে ভিড় করে আরো বহু ধরনের মেধাবী সব তরুণ। আমার এই ছোটমা’র কিশোরী মনেও সেই সুকুমার বৃত্তির স্রোত এসে লেগেছিলো। অনেক রাত পর্যন্ত ছেলেরা গান গাইতো, কবিতা আবৃত্তি করতো। নাটকের রোমাঞ্চকর সব সংলাপের প্রতিধ্বনিতে ভরে যেত চারদিক। অন্দরে অধীর হয়ে জেগে থাকা সেদিনে কিশোরী এই ছোটমায়ের দুটি কানেও তার রেশ গিয়ে পৌঁছতত। ঘরে হারমোনিয়াম পেলে বাজিয়ে এক-আধটু গাইতো সে। তারপর এক এক করে অনেক রাত পালিয়ে মিশে গিয়েছিলো ছেলেদের সেই আড্ডায়। আর সেটাই হয়েছিলো তার জন্য চরম কাল।
‘ছেলে দেখলে লিকলিক করে ওঠে ও মেয়ে! এতগুলো ছেলে একসঙ্গে দেখে আমরা হলে লজ্জায় দম আটকে মরতাম।’ এমনতর বহুধরনের অপবাদ দিতে পক্ষপাতী শুধু ও বাড়ির মেয়েমহলই নয়, পুরুষগণও কম ছিলো না তাতে। তার উপর বাপ যদি হয় বিচার-বুদ্ধিহীন, হিংস্র। মা’রও যদি না থাকে সন্তানদের মনস্তত্ত্ব বোঝার সংবেদনশীল অনুভূতি। দরিদ্র পিতার ঘরে এমন অভিশপ্ত জীবন! মরতে চেয়েছিলো ছোট মা। মৃত্যু তাকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু ছোট মাকে একজন তো ভালোবাসতো! তবু কেন সে মরতে যাচ্ছিলো। নাকি বিশ্বাসে জোর পাচ্ছিলো না। দারিদ্র কি এমন কিছু যার দহনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অঙ্কুরিত স্বপ্নের কুঁড়িটিও?
আমার বাবা স্বাস্থ্য, চেহারায় সুপুরুষ। কিন্তু স্বভাবে কাঠখোট্টা। বরাবরই এমনটি দেখেছি। আমার মায়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, তাও বহুদিনের অভ্যাসের ফসল। ছোটমায়ের সঙ্গে তাকে শুধু খাবার টেবিলে ব্যস্ত হাতে খেতে খেতে রকমারি ব্যঞ্জনের স্বাদের রকমফের আলোচনা ছাড়া আর কোনো কথা বলতে শুনিনি। ইদানিং ছোটমা প্রায়ই আমার পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ভাবি, বাবা এসে নিশ্চয় কোনো অজুহাতে তাকে ডেকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আমার জানা মতে তেমনটি ঘটেনি কোনোদিন। তাতে আমার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না দেখে স্বস্তি পাই।
আমি আর ফেরদৌস পাঁচ বছরের ছোটবড়। আঠারো এবং তেরো বছরের এমন দুটি ছেলেমেয়ে আমার বাবার আছে, সেই পাঁচ বছর আগের অচেনা কেউ ঘরে এসে না দেখলে বিশ্বাস করতো না। ছোট মায়ের গার্জিয়ান নিশ্চয়ই সব বিষয় হিসাব মিলিয়ে তবেই এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু ছোট মা যে আর কোনোদিনও তার বাবার বাড়ি গেলো না! বাবা কতবার সকালে অফিসে যাওয়ার আগে তাকে বলে গেছেন ‘তোমার বাবা একা যেন ফিরে না যান। তুমি যেও। কদিন থেকে এসো। বাড়ির সবাই নিশ্চয় তোমাকে এবারো না দেখতে পেলে মন খারাপ করবে।’
বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বাবা তার সমান বয়সী, অর্ধশিক্ষিত শ্বশুরের প্রতি ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের বিনয় ও অস্বস্তি মেশা একটুকুরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে দুপুরে ফিরে এসে দেখেছেন জোয়ানমর্দ শ্বশুর সাহেব চলে গেছেন। আর তরুণী বধূটি তার স্বামীর জন্য টেবিলে খাবার সাজাতে শশব্যস্ত।
‘কেন যাওনি তুমি? ওদের ওপর তোমার কীসের এত রাগ? কিসের অভিযোগ তোমার? কে তোমাকে এত শক্তি যোগায় এতটা অটল থাকতে?’ এমন দু-চারটি অভিযোগের মৃদুু ভারও ছোটমাকে যে চাপানোর সাহস বাবা রাখেন না, তা এতদিনে আর কাউকে বলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। সারাক্ষণ এমনই এক অসহ্য কাঠিন্য ছোটমা ধারণ করে রাখে তার কোমল দ্যুতিতে।
কদিন মাত্র আগে আমার বিছানায় কোণাকুণি হয়ে শুয়ে ছিলাম। ছোটমাকে আমার মাথার কাছে বসতে হলে তার জন্য আমাকে একটু সরতে হয়। কিন্তু তাকে সেটুকু অধিকার ছাড়তে আমি নারাজ। ফেরদৌসও। তবে মহিলার সেবা নিতে মন্দ লাগেনি। উহ! মা মারা যাবার পর দেখছি না, বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করতো। আমাদের প্রতি অভিভাবকত্ব দেখাতে এসে নিজেরা নিজেরা প্রায় হাতাহাতিও লেগে যেত। অথচ সময়মতো চারটে ভাত কেউ দিতে পারতো না। বাবা বিয়ে করে আনার পর আমার নানীও কম তক্কে তক্কে থাকেননি। ছোট মার নিষ্ঠার কাছে পরাস্ত হয়ে ফিরে গেছেন তিনিও।
ছোটমা তবু কষ্ট করে আমার মাথার কাছে বসলো। বুঝলাম, ভয়ে ভয়েই আমার কপালে একখানা হাত রাখলো। তার জ্যাঠামিতে আমার সংকোচ হচ্ছিলো। তবু দায়িত্বের সুরে বললো, ‘তুমি কার সঙ্গে টেলিফোনে এতসব কথা বলো?
-মহিলার স্পর্ধা দেখে জ্বলে উঠলাম, ‘তা জেনে তোমার কী হবে’
-যে ছেলেটি এসে অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করে, যার সঙ্গে বেড়াতে যাও তাকে আমার ভালো লাগে না।
-ভালো-মন্দ বোঝ তুমি?
-হয়তো না!
-তাহলে?
-একসঙ্গে বসবাস করতে গেলে পরস্পরের প্রতি এমনি দায়বদ্ধতা জন্মে। তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটি… সময়ও তো কম হলো না! প্রতিদিন পায়ে পায়ে তুমি সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছো! জানো, তোমার পাশে ওকে মানায় না। তুমি কিছু বোঝ না। তোমাদের জীবন তো সরলরেখার মতো। হোঁচট খেতে হয় না। তাই জীবনের কদর্য দিকটা অজানাই থেকে যাচ্ছে তোমাদের কাছে।
-জীবনের তুমিই বা কতটুকু দেখেছো?
-বাজিয়ে তো দেখতে চাইনি কিছু! সেও আরেক ধরনের বিলাসিতা। আমরা যেখানে জন্মেছি সেখানে তা মানায় না। সাহসের কথা না হয় বাদই দিলাম।
-শোভনের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। এতে আমি কারো আপত্তি মানবো না।
-তোমার বাবা জানেন?
-না, তবে আমার পছন্দকে তিনি অস্বীকার করবেন না। করলেও আমি তা মানবো না। পারলে বলে দিও।
-তোমার বাবা যে ওকে মেনে নেবেন, কী কী যোগ্যতা ওর আছে?
-ও এমএ পাশ করতে পারেনি। তা হোক, ওদের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে।
-ও নিজে কী করে?
-এখনো কিছু করে না। প্রয়োজনীয় টাকা চাইলে তো ওর বাবার কাছে পায়।
-কিন্তু যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে ভাবছো, তার সঙ্গে এত গল্প করতে নেই। এত সময় একসঙ্গে কাটাতে নেই। এতে তোমার আবেদন ওর কাছে নষ্ট হয়ে যাবে। ওতো তোমার বন্ধু নয়, প্রেমিক। যতটা পারো ওকে আড়াল করে থাকবে বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত।
এতক্ষণ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে। একটা গেঁয়ো ভূত যাকে ভেবেছিলাম। শুধু একটু আশ্রয় ও খাদ্যের জন্যে আমাদের বাড়ি পড়ে আছে ভেবে অবহেলা ছাড়া সম্ভ্রম দূরে থাক, প্রাণভরে করুণাও যাকে করিনি এতদিন, আজ সে-ই যেচে এসে আমার গভীরতম অন্ধকার দুর্বল বোধে এভাবে ছড়িয়ে দিলো আপনালোর রশ্মি!
-পাঁচ বছর হলো এই প্রথম মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো ছোটমা। তাও মা নয়, ছোটমা। বললাম, ছোটমা তুমি এতসব জানো, বোঝ?
-তোমার মতো বিষয়টি আমার নিজের হলে আমি বুঝতাম না। তোমার বলে বুঝতে পারছি। গা ঘেঁষে বসি ছোটমার। অধিকার পেয়ে ছোটমা বলে যায়, তুমি যে বললে তোমার বাবা ওকে মেনে নেবেন, কিন্তু ওই ছেলে শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না?
-ও-ই তো আমাকে রাজি করিয়েছে। আমি তো ধরাই দিতে চাইনি!
-কিন্তু ওকে দেখে আমার কী মনে হয় জানো? আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি ছোটমা’র তীক্ষè দু’টি চোখের দিকে। খুব ধারালো স্বরে ‘আদর্শহীন’ শব্দটি উচ্চারণ করে ছোটমা তা ছুরির মতো গেঁথে দিলো আমার বুকে। আমি ফালাফালা হতে থাকি আর ছিন্নভিন্ন হতে থাকে আমার বিশ্বাস।
ছোটমার কথাগুলো মানতে চেষ্টা করি। শোভনের সঙ্গে আর যেচে কথা বলি না। লুকিয়ে দেখাও করি না। যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞাটি পোক্ত হতে না হতেই জানতে পারলাম অন্যত্র ওর বিয়ের আয়োজন চলছে। প্রতিবাদ করতে ওর মুখোমুখি হতে চাইলাম। টেনে ধরলো ছোটমা। বললো নিজে হাটে হাঁড়ি ভাঙার মতো ওইটুকু কাজ অন্তত আর করতে যেয়ো না। এতে তোমারই ভালো হলো। কান্না দমাতে না পেরে ছোটমার বুকে মুখ লুকিয়ে বললাম, ছোটমা আমি ঠকেছি!
আমাকে প্রবোধ দিতেই কি ছোটমা বললো-‘ঠকা-জেতার কথা এখানে থাকতে নেই। তুমি ওকে ভালোবেসেছিলে। ভালোবাসতে পেরেছিলে। সেটুকুও তো সঞ্চয়। জীবনে ওটুকু তোমার কাজে আসবে।’
ছোটমার প্রতি আমার জড়তা কাটতে দেখে ফেরদৌসও সহজ হয়ে গেছে। এতেই জগতে যেন আর কোনো দুঃখ নেই। চাওয়ারও নেই। জনম জনম এমনি একটি সংসারের স্বপ্ন দেখেই বুঝি সে সার্থক হয়েছে। ভাবখানা তার সারাক্ষণ এরকম।
অধিক রাতে এসে চারটে খেয়ে শুয়ে পড়া। দুপুরে খেয়ে ছুট। ছুটিছাটা বলেও কেন শব্দ আমার বাবার অভিধানে নেই। আর এতেই যেন ছোটমার স্বস্তি। ছোটমার গ্রাম থেকে বাবা, মা ভাই, বোন-আত্মীয়-স্বজন যে-ই আসছে, ছোটমা তাদের চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেয়। ওর শেকড় যেন বহু আগে থেকে এ সংসারে গ্রোথিত। ওরা যেন তার কেউ নয়। শুধু কদিন একসঙ্গে ছিলো এই যা। যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝে যায়, পুরনো সব বন্ধনকে কী নির্মম কৌতুকে ছেঁড়া জালের মতো ঝুলিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। ক্রমশ এতে কৌতূহল বাড়তেই থাকে সবার। আর তাদের সঙ্গে যোগসূত্রটা সেখানেই ঠেকে থাকে।
ছোটমার সঙ্গে এখন আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে কোনো পাখির যেমন পল্লবিত কোনো শাখার সঙ্গে হয়। একা ঘরে যখন আমার চোখ বেয়ে শুধু পানি পড়ে, ছোটমা কাছে এসে দাঁড়ালে তা উথলে ওঠে। ছোটমাকে সব কথা বলি এখন। মা মারা যাওয়ার সময় মা’র কষ্ট দেখে আমারও যে কষ্ট হয়েছিলো। এবং শোভনের সঙ্গে আমার কেমন করে কোথায় পরিচয় হয়েছিলো। কিছু দুর্লভ স্মৃতির কথাও তাকে অকপটে বলা হয়ে যায়। সব শুনে ছোটমা কেমন বিচলিত হয়ে ওঠে। মা থাকলে যেমন হতো।
আমার রুমটি ড্রয়িং রুমের পাশে। তারপর ফেরদৌসের। কেউ এলে কাজের লোকেরা কাছে না থাকলে আমাকেই গিয়ে দরজা খুলে দিতে হয়। তাছাড়া সারাদিন শুয়ে-বসেই তো কাটাই। লেখাপড়া কি বন্ধ হয়ে গেলো আমার। বাবা কোনদিনই তো খেয়াল করেননি। মা-ই আমাদের সবদিক সামলেছেন। শোভনের সঙ্গে জড়িয়ে কটা বছর ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। একবার অনার্স ফেল করলাম আর একবার পরীক্ষা দিলাম না। ছোটমা অবশ্য সারাক্ষণ বকছে ভালো করে লেখাপড়া শুরু করতে। বলছে এবার পরীক্ষা দিতেই হবে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বাবা শুধু তার মাপের উপদেশ পরামর্শ আর থোকা থোকা টাকার বান্ডিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত। অথচ ফেরদৌসের লেখাপড়া তদারকিটা তিনি করেন ঢের বেশি গুরুত্ব দিয়ে।
শহরের একঘেয়ে কোলাহল আর কঠিন প্রাচীর আবদ্ধ হয়ে থাকা মানুষগুলোর ঋতুজ্ঞান থাকে না বললেই চলে। শুধু গরম আর শীতের পরশটুকুর সঙ্গে তারা পরিচিত হয়ে থাকে আজীবন। হয়তো হৃদয়ে কখনো কোনো সুর গুঞ্জরিত হতে চাইলে বসন্ত শব্দটিও মনে পড়ে। কিন্তু পাঁজর ভেঙে উথাল-পাতাল ঢেউ যখন ভাসিয়ে দেয় তাদের কারো সবকূল, তাও মৃদু, পেলবতায় নয়, নির্মম ঝাপটায় পাহাড় সমান হয়ে। তখন বাইরের তীব্র আলো কী নিকষ অন্ধকার, চাঁদ কিংবা সূর্যে গ্রহণ লাগলো কিনা, সেটি বড় কথা নয়। আমারও ঠিক তেমনি একটি সময়ে একটানা কলিংবেল বেজেই চলেছে। কেউ দরজা খুলছে না দেখে ফেরদৌস খুলে ছোটমাকে ডেকে নিয়ে আমার দিকে ছুটে এলো গজগজ করতে। কদিন পরই ওর এসএসসি পরীক্ষা। অথচ আমি বসে থেকে দরজা খুলছি না। ও আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলেই চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে গেলো ‘তোর মন খারাপ থাকলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে আপা।’ ওর কথা শুনে চমকে উঠি আমি। ছোটমার সব রহস্যময়তার জট যেন আমার কাছে খুলে যায় তাতে। একজন মানুষ কখনো শুধু তার নিজের নয়, একজনের দুর্ভোগ আরেকজন পোড়ে। আর তাই বুঝি ছোটমা তাদের সবাইকে দায়মুক্ত করতে আপাংক্তেয় হয়ে থাকতে হবে জেনেও আমাদের ঘরে এসে সবাইকে বাঁচিয়েছে। জীবনে যারা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে অভাব এবং নানান অভিযোগের মধ্যে মানুষ হয়, তারা বাধ্য হয়েই অনেক কিছু আগেই শেখে। সময় এবং জীবনের ব্যবহার তারা করতে চায়। ছোটমাকে দেখে ইদানিং আমার তাই মনে হয়। কিন্তু একই বৃন্তে দুটি ফুলের মতো আমার ভালো-মন্দে যে অন্য আরেকজন ভুগছে, এটুকু বোধ জাগতেই আমার এতটা সময় লাগলো।
আমার রুম আর ড্রয়িং রুমের মাঝখানের দরজাটি খোলা ছিলো। তবে জমকালো, ভারি পর্দা তাতে ঝুলছে। সে পর্দা ছাপিয়েই দু’জন মানুষের সব কথা আমার কানে চলে আসতে থাকে। ক্রমে তা কৌতূহল বাড়ায়। আমি অধীর হয়ে আরো উৎকর্ণ হই।
-কেমন আছো? অপরিচিত, থমথমে কণ্ঠস্বর।
-ভালো। তুমি? ছোটমার কণ্ঠ কাঁপা কাঁপা শোনায়।
-ভালো থাকতে দিয়েছো তুমি?
-কারো মন্দ থাকার মতো আমি কখনো কিছু করিনি।
-আমি বিসিএস পাস করেছিলাম।
-হাঁ, কে যেন বলেছিলো, ঠিক মনে পড়ছে না।
-আমার চাকরি হয়েছে। কালই জয়েনিং ডেট। কিন্তু তার আগে আমি তোমার কাছে না এসে পারলাম না। আর পারছি না আমি।
-কেন? আমি তোমার কোনো কাজে আসতে পারি?
-কেন? বোঝ না? তুমি কি সব ভুলে গেছো? তাছাড়া আমার যন্ত্রণার কথাগুলো কেউ-ই কি তোমাকে পৌঁছে দেয়নি? উহ্ মানুষের বিশ্বাস এত ঠুনকো হয়? ভাবাই যায় না। কেন তুমি এ বিয়ে থেকে পালিয়ে বাঁচলে না।
-তুহিন ভাই, একটি দুর্বল মুহূর্তে সেদিন সেই শপথের জোরে তুমি আমাকে খুঁজতে আসোনি। জসিম মোল্লার পুরনো ভাঙা টিনের ঘরে আজ তার আইবুড়ো মেয়েটির কাছে তুমি যেতে না। শপথ নামের শ্রুতিমধুর সেই দু-চারটে বুলি আজ তোমার মনেই থাকত না! কেননা তোমার আজকের আত্মবিশ্বাস আর গ্ল্যামারের পক্ষে এ দৃশ্যটি সেখানে হতো একেবারেই বেমানান।
-আর কী করলে বিশ্বাস করবে, আমি কথা রাখতেই এসেছি। আমি আজ তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি শাহানাজ।
-আজ তুমি আমাকে নিয়ে যেতে আসোনি। পুরনো কেন স্মৃতির টানেও নয়। প্রেমিকা এখন কোনো ধনী-সম্মানী লোকের স্ত্রী বলে এসেছো। নিজেকে দেখিয়ে তার চোখ বঁধিয়ে দিতে এসেছো! এ-ও এক ধরনের নিষ্ঠুর আনন্দ। কিন্তু তোমার এ মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হওয়ার নয়। কোনো কিছুতেই আমি আর আসক্তি অনুভব করছি না।
‘কী ঠাণ্ডা’ অথচ কী ভীষণ কঠিন শোনায় ছোটমার সংলাপগুলো। জীবনের এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা আগুনের ফুলকির মতো ছোটমার মুখখানা তখন দেখার অদম্য কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারলাম না। পর্দাটি সরাতেই দেখলাম স্বপ্নালোক থেকে নেমে আসা লোকটি ছোটমার একখানা হাত ধরে ফেলেছে। ছোটমা তার হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো। সব পরিস্থিতিতে সে নিজেকে সামালে নিতে জানে বটে। এবারও নিলো।
না হলে এমন উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার পরম মুহূর্তে কেমন করে বলতে পারলো-‘দেখো তুহিন ভাই, আমার মেয়ে। কী সুন্দর দেখেছো? ইডেনে অনার্স পড়ছে। ছেলেটি এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এরা শহরের ছেলেমেয়ে তো। লেখাপড়ায় তরতর করে এগিয়ে গেছে। ওদের মতো বয়সে আমরা আরো নিচের ক্লাসে পড়েছি। আমার প্রতি তুহিনের ঈর্ষান্বিত, তাচ্ছিল্যপূর্ণদৃষ্টি ছোটমাকে অপ্রস্তুত করে দিচ্ছে। আর আমি আশ্চর্য ও বিব্রত হলাম আমার বয়স লুকোতে ওর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার প্রতিভা দেখে। কিন্তু অপ্রস্তুত বা বিব্রত হলে তো চলবে না। আমাকে ওদের পাশে অনুমতি ছাড়া বসে পড়তে দেখে সব কাজের কথা ভুলে ছোটমাও গেড়ে বসলো সেখানে। তবে হয়তো ইচ্ছে করেই অনেকক্ষণ কথা বললো না। হয়তো পরিবেশটাকে থমথমে গম্ভীর করে নিতে চাইছিলো কিছুটা নীরবতা গেঁথে।
এভাবে তিনজন মানুষের আপ্রাণ চেষ্টায় কতটুকু তা সফল হয়েছিলো তা কেবল ছোটমা-ই জানে। না হলে একটু পরেই সরে এসে দীর্ঘদিন পরে দেখা এমন সম্পর্কের একটি মানুষের হাত ধরে, কেমন করে বলতে পারলো, ‘তুহিন ভাই আমার মেয়েটিকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই, অমত করো না। বড় লক্ষ্মী ও মেয়ে আমার। ওর বাবা বেখেয়ালি মানুষ। অনেকদিন থেকে আমি ভালো একটি ছেলের সন্ধান করছিলাম।’
-এতবড় মেয়ের মা হওয়ার বয়স তোমার হয়নি। নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করবে করো। আমাকে জড়িও না। তুমি শত্রুর মধ্যে বসবাস করছো। এত বছরে নিজের সন্তানের মা হতে পারলে না। সময় এলে ঠিকই বুঝবে কী প্রহসনের মধ্যে আছো।
-তাহলে আমার শত্রুকে উদ্ধার করে এই বাড়িটিই আমার নিরাপদ করে দাও। বিদ্রুপাত্মক কথা বলে ছোটমা হাল্কা করে দিতে চাইলো তুহিনের ক্ষোভ। এবং এরই মধ্যে দ্রুত ঘটিয়ে ফেললো সেই অভাবনীয় কাজটি। আমার হাতখানা টেনে নিয়ে তুহিনের হাতে সঁপে দিয়ে একতরফাভাবেই বলে গেলো, আমাকে তুমি কথা দাও, নিরাশ করো না। বাকি জীবনেও তোমাদের কারো কাছেই আমি আর কিছুই চাই না। এমনি করে তোমাদের কেউ নই হয়ে দূরে থেকে যাবো। সে বিশ্বাস তোমরা রেখো।
আমি তুহিনের সম্মতিসূচক কোনো শব্দই শুনিনি। হয়তো ছোটমা তার চোখে অপারগ সম্মতির কোনো আভাস দেখেই আঁচল টেনে ঘোমটা দিলো। মুখখানাও একটু ঘুুরিয়ে ফেললো।
অচেনা একজন পুরুষের হাতের মধ্যে আমার হাত। ক্ষণিকের মধ্যে ঘটা সবগুলো ঘটনার রেশ আমি ভুলে শুধু ছোটমার চোখ দুটির উপর ভয়ঙ্কর তীরের মতো নজর ফেলে তাকিয়ে রইলাম। হীরের চেয়ে দামি দু’ফোঁটা অশ্রু আজ এক্ষুনি, এই প্রথম হয়তো-বা শেষবারের মতো দেখতে পাবো। কোথাও দৃষ্টি সরাই না। যদি এরই ফাঁকে ঝরে যায়।
আমাকে আবারও অবাক করে দিয়ে ছোটমা শুকনো দুটি চোখে আমার মুখে উপর কেমন এক দৃষ্টি প্রসারিত করে রাখলো। কখনো তুহিনের মুখেও। বিদ্যুতের শকও কি এর চেয়ে যন্ত্রণার হয়! অতীতের সব বেদনা আমি ভুলে গেলাম এই মুহূর্তটির তড়িৎ প্রবাহে।
অন্য কোনো অনুভূতি আমার মধ্যে কাজ করছে না। শুধু ভাবছি কত জনম সাধনা করে, কতটা কষ্ট করে ছোটমা এ সিদ্ধি লাভ করলো। অনেক দিনের ভাঙা মন আমার তুহিনের হাত থেকে এক ঝটকায় হাতখানা ছাড়িয়ে নিজের ঘরে এসে উপুড় হয়ে পড়লাম। ভাবছি, আমার পাপ কি এতটাই বেশি ছিলো যে একটি অক্ষম, অভিশপ্ত পরিবারের পুঞ্জীভূত গ্লানির অসহ্য ভার আমাকে চিরদিন এভাবে বইতে হবে! তীব্র আর্তনাদে কাঁপিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো এ বাড়ির প্রতিটি দেয়াল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ‘ছোটমা এ তুমি কী করলে? এই মুহূর্তে তুমি কারো হাত ধরে চলে গেলে পৃথিবীর কারো এতটা ক্ষতি হতো না, যতটা ক্ষতি তুমি আমার করলে?
সূর্য কোথায় ডোবে এখানে তা বোঝাই যায় না। প্রাসাদের সব চূড়ায় আগেভাগেই ঢাকা পড়ে যায় তার কমলা রং শরীর। তবে গলে গলে কিছুক্ষণ ঠিকই ঝরে নিষ্প্রভ ছটা। এমনসব সময়ে ছোটমাকে আরো উজ্জ্বল মনে হয়। সোনালি সে আভায় আমার বাবার জ্যোতি বেশ ম্লান দেখায় ওর পাশে। আজ পোড়া চোখ-দুটি তুলে এমনতর ছোটমার দিকে তাকাতেই পারছি না। আমার সমস্যা হচ্ছে বুঝেই বুঝি ছোটমা এগিয়ে এলো সমাধানে। আমাকে কাছে টেনে বললো, ‘তোমার সংসারটি আমি নিজ হাতে সাজিয়ে দেবো। আজই তোমার বাবাকে সব কথা বলবো। তুমি লেখাপড়া ছেড়ো না কিন্তু…। স্বামীর যোগ্য হয়ে উঠতে না পারলে বিয়েটা দাসত্বে পরিণত হয়ে যায়।
ছোটমার চোখের বিদ্যুতে শক খেতে খেতে তবু আমি তাকিয়ে থাকি। ভীষণ কষ্ট হয় তবু চোখ ফেরাই না। দুর্বোধ্য, জটিল সে অভিব্যক্তিতে আমার উপলদ্ধি মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত হয়।
ভেবেছিলাম, একদিন ছোটমাকে বলে দেবো-‘ছোটমা তুমি যাকে ছাদে জমানো পানি ভাবছে, ওটা আসলে ভীষণ দীর্ঘ একটি পুকুরের একটি চিলতে মাত্র, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস-এর ভেতরকার। শান-বাঁধানো ঘাট এবং সারি গাছও আছে ওর পাড়ে। হাঁস সাঁতার কাটে। শৌখিন শিকারীরা ছিপ ফেলে ওখানে মাছ ধরে, তোমাদের গ্রামের পুকুরগুলোর চেয়ে এটা আরো ভালো হয়তো। আমি আর শোভন কতদিন ওর পাশ দিয়ে হেঁটেছি। কিন্তু ওসবের কিছুই আর বলি না। মনে হয় স্বপ্নেই কেবল পারে মানুষকে বুঁদ করে রাখতে। আত্নহননের পথটিকে ভালোবাসলে তাও ক্রমে মসৃণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া ওই জলাধারটিরও তো একটি সীমানা আছে! মাত্রাও আছে গভীরতার। কিন্তু স্বপ্নের তা নেই। ছোটমার স্বপ্নহীন দুটি চোখের দেখা শুধু এটুকু ভ্রান্তিও যদি তাকে কোনো একটি খোলা জানালায় প্রতিদিন এভাবে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে, থাক তবে সেটুকুই অটুট হয়ে।

দীলতাজ রহমান : কথা সাহিত্যিক

Print Friendly

Related Posts