মানুষটি আজও জানালা খুলে : স্বদেশ মানচিত্রের কাব্যিক ভ্রমণচিত্র

শিউল মনজুর

 

এক.
কবি হাবিব ফয়েজির, “মানুষটি আজও জানালা খুলে”- ৬৪টি পৃষ্ঠার কবিতা বই সংগ্রহ করেছিলাম নিউ ইয়র্ক বইমেলায় ২০১৮ সালে। কিন্তু পড়বো পড়বো করে আর বইটি হাতে নেয়া হয়নি। বলা যায় বইটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ করে মনে পড়তেই এলোমেলো বইয়ের স্তুপ থেকে খুঁজে বের করি এবং বইটিতে মুদ্রিত ৫৬টি কবিতা পড়তে পড়তে বেশ কয়েকটি কবিতা আমার মধ্যে একধরণের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়, মনের অজান্তে। কয়েকটি কবিতা একাধিকবার পাঠও করেছি। মনে হয়েছে তিনি যেনো কবিতার বিষয়গুলি নির্বাচন করে অতঃপর মনের আবেগ ভালোবাসার রঙ মিশিয়ে পঙক্তিতে পঙক্তিতে জীবন্ত করে তুলেছেন।

 

দুই.

বইটিতে বাবা শিরোনামের একটি কবিতা আছে। কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবির আঁকানো বাবার মুখটি যেনো আমাদেরই সকলের বাবার মুখ। কবিতাটির অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করছি;

 

মনে পড়ে, আমি বড়ো হলাম
আর বাবা যেন শিশু হয়ে গেলেন
আমার হাত ধরে তখন বাবা মসজিদে যেতেন
জুম্মাবারে সময়ের আগেই শ্রভ্র সফেদ পোশাক
আর চোখে সুরমা, গায়ে আতর মেখে প্রস্তুত
আর বাজারে যেদিন নিয়ে যেতাম
সেদিন যেন বাবার ঈদ হয়ে যেত (পৃষ্ঠা-১০)।

 

দৃষ্টিভঙ্গি শিরোনামের আরেকটি কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করছি;

 

আম্মা বলতেন- “প্রতিদিন বই না পড়ে তো ঘুমাও না ঠিকই
কী লাভ হয় এসব বই পড়ে শুনি?
সপ্তাহে তো একটা দিনও কুরআন তিলাওয়াত করো না
অথচ তুমি জানো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠগ্রন্থ হচ্ছে আল কুরআন,
যার একটি অক্ষর পড়লে দশটা সওয়াব।” (পৃষ্টা-৬৩)।

 

এই কবিতা দুটির গল্পগুলো আমাদের জীবনের, আমাদেরই একান্নবর্তী সমাজের চিত্র এবং তিনি তাঁর নিজস্ব স্বভাব সুলভ বর্ণনার মধ্যদিয়েই বুনন করেছেন গল্পগুলোর বাস্তবচিত্র। এখান থেকেই পাঠক খুঁজে পাবেন তাঁর স্বপ্ন দেখানো পথের বাবার গল্প, তাঁর মমতাময়ী মায়ের সন্তানদের নিয়ে চাওয়া পাওয়ার গল্প। যাদের গল্পের ডালপালাগুলো বা স্বপ্নগুলো সন্তানদেরকে নিয়েই আবর্তিত।

তিন.

হাবিব ফয়েজি, কবিতার মধ্যদিয়ে দৃষ্টির ফোকাস নিক্ষেপ করেছেন এবং ফোকাসের মধ্যদিয়ে যা অবলোকন করেছেন বা তাঁর দৃষ্টি ক্যামেরায় ছবির মতন যা উঠে এসেছে তাই অকপটে বলেছেন। তাই তাঁর কবিতায় স্বদেশ কিংবা সমাজের ভালোলাগার মন্দলাগার অনেক চিত্রই প্রত্যক্ষ করি সরাসরি। বিজয় দিবস এবং কিছু কথা শিরোনামের একটি কবিতায় আমাদের বর্তমান সমাজের একটি বিশেষ দিক তাঁর কাব্যসৃষ্টির ক্যামেরার ফ্লাশে জ্বলে উঠেছে এভাবে;

 

বয়স বাড়লো, বড়ো আর হলাম কই?
কিংবা দেশপ্রেমিক? কতটা বা হতে পারলাম?
আজ যখন দেখি রাজাকারের বাচ্চারাও
বিজয় দিবসে মিথ্যার বুলি আওড়ায়
অথবা বর্ণচোরা রাজাকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে
কিছু সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা না বুঝে অংশ নেন
তখন বাবার কথা মনে পড়ে-
বাবা বলতেন আর যা-ই করিস
রাজাকারের রক্ত হতে সাবধান থাকিস
এ বড়ো অপবিত্র রক্ত!
তারপর থেকে-
আমার সমূহ ঘৃণা এ রক্তের প্রতি (পৃষ্ঠা-১১)।

হাবিবের কবিতায় উঠে আসা এইচিত্র আমাদেরকে আহত করে, রক্তাক্ত করে অথচ এই চিত্রই আমাদেরকে প্রতিনিয়ত দেখতে হয়, শুনতে হয় এবং দাঁতচেপে বহন করতে হয়।

 

চার.

হাবিব ফয়েজির কবিতা সমকালকে ধারণ করেছে। স্বদেশ ক্যানভাসের অন্ধকার ও আলোকরশ্মির ধারায় তিনি আমাদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন ঘাত প্রতিঘাতের নানাছবি। অনেকাংশে তাঁর বলার স্বর তীব্র ও বিদ্রোহী চেতনাকে ধারণ করেছে। বিক্রয় নোটিশ (পৃষ্ঠা-১৪), নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘৃণা করছে এখন (পৃষ্ঠা-১৫), পরিবর্তন ভাইরাস (পৃষ্ঠা-৫৯), বাবার মুজিবকোট এবং (পৃষ্ঠা-৬০), ক্ষমা করো প্রিয়তমা (পৃষ্ঠা-৬৪) প্রভৃতি কবিতায় প্রতিবাদী মানসচিত্রের উপস্থিতি বিদ্যমান।

আবার বেশ কিছু কবিতায় তাঁর মধ্যে বিরহী চেতনার প্রভাব লক্ষণীয়। অনেক কবিতায় বিচ্ছেদ বেদনার উৎসারিত সারাংশ পঙক্তিতে পঙক্তিতে জেগে উঠেছে। বিশুদ্ধ পাপ (পৃষ্ঠা-২০), মনে পড়ে (পৃষ্ঠা-৪০), তারপর যা হল (পৃষ্ঠা-৫১), তুমিহীন আমি এবং আমার বর্তমান (পৃষ্ঠা-৫৪), দীর্ঘশ্বাসের কারণ (পৃষ্ঠা-৬২) প্রভৃতি কবিতার মধ্যে একজন কবির ব্যক্তিমানসের ভেতর বিরহী সুরের আকুল আর্তনাদের শব্দ শুনি।

পাঁচ.

ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের কবিতার সমষ্টি “মানুষটি আজও জানালা খুলে” বইটির উৎসর্গে ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছেন, রোমানা হাবিব। সালমান ফরিদ সাহিত্য ক্ষেত্রে একজন প্রতিভাবান লেখক বলে মনে করি। এবার তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এই কবিতা বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদও করেছেন। সিলেটের বাউলা থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য ১২৫ টাকা ($৫) ।

 

এই বইটি পাঠ করে একটি সকাল ও একটি বিকাল পার করেছি। আমার সরল স্বাকারোক্তি; মনে হয়েছে স্বদেশের ভেতর দিয়ে সময়কে পার করেছি। কখনো আনন্দে, কখনো ভালোলাগায় আবার কখনো বেদনায় বা বিষাদে। বইটি পাঠ করে আপনিও স্বদেশের মুখচ্ছবি অবলোকন করতে পারেন।

 


শিউল মনজুর ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Print Friendly

Related Posts