আতাতুর্ক পাশা
ITমরণ হেলেন ওসমানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। হেলেন ওসমান দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। বেশিরভাগ সময় তিনি কবিতা লেখেন। তাঁর পিতা যাযাবর ওসমান ষাট দশকের কবি ও কথাসাহিত্যিক। এখনো তিনি লিখছেন। পিতার কাছ থেকে পাওয়া নেশায় তিনি লেখেন। মুলতঃ লেখালেখি তাঁর নেশা রক্ত, মাংসের সাথে মিশে গেছে। এ কাব্যগ্রন্থটি তিনি প্রবীণ সাহিত্যিক সাবির আহমেদ চৌধুরীকে উৎসর্গ করেছেন। চল্লিশটি কবিতা নিয়ে এ কাব্যগ্রন্থ।
যখন দশম শ্রেণিতে পড়তাম, তখন বাংলা সংহিতায় কবিতা পাঠ্য থাকত। কবিতাশেষে অনুশীলন থাকত। তাতে একটি প্রশ্ন প্রায় সব কবিতায় থাকত, তা হচ্ছে ‘নামকরণের সার্থকতা’। আমাদের অনেক সময় এ প্রশ্নের উত্তর-মান ছিল ৫। এই ৫ নম্বর পাবার জন্য আমাদের কম করেও দশ চরণের সন্নিবেশ করতে হতো। সমগ্র কবিতাটি পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবন করে তারপর নামকরণের সার্থকতার পক্ষে মতামত লিখতে হতো। এ কাব্য সংহিতাটির কবি হেলেন ওসমান নামকরণ ইংরেজি বর্ণমালা I ও T তারপর, শব্দ যোগ দিয়েছেন মরণ।
বইটির ৪০টি কবিতা দীপ্ত নয়নে পড়লে প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই একটি মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় যদিও ITমরণ নামে তাঁর একটি কবিতা আছে। সে কবিতাটিই আমাদের একটি বার্তা দেয় যে, মৃত্যু আসছে, মৃত্যু অনিবার্য যদিও আমরা এখন দ্রুতগামী পৃথিবীর IT যুগে প্রবেশ করেছি। লেখক একজন ইঞ্জিনিয়র তাই হয়ত তিনি IT বর্ণ দু’টোকে ইংরেজিতে রেখেছেন, কারণ সংক্ষেপে হয়ত এর প্রতিশব্দ তিনি পাননি। তবে এটা আমার চোখে নতুন নয়, এর আগেও কবিতার ভেতর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি আরো দু’একজন কবিতা লেখককে।
হেলেন ওসমান তাঁর যৌবনের ফলাফল কবিতায় লেখেন, “যৌবন প্রভাতে প্রস্ফুটিত/ কুসুমের ন্যায়,/ কখনো দ্বি-প্রহরে ঝরে,/ কখনো সামান্য বিলম্বিত/ হয়ে পরদিন ঝরে\” (পৃ-৩৬)।
“একটানা বাদলঝরা দিনে/ আমি সিক্ত, আমি অঝোর/ ধারায় ভিজে যাওয়া লতা-পল্লবী\ . . . সুচের হ্রস্ব ফোঁড় গাঁথল/ নকশিকাঁথা, জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র/ মুহূর্ত নিক্ষেপ করল আমারে/ সাঁঝের পানে।/ যে বেলায় এতটুকু নেই হৃষ্টি/ আছে শুধু হারিয়ে যাবার আশঙ্কা\ (আশঙ্কা : পৃ-১৭)।
“আমি জানি না আমার ফ্লাইট/ কবে, কোন Airport-এ। আমি জানি না আমার শেষ যাত্রা/ কবে, ধরিত্রীর কোন স্থানে\ আমি জানি না বিদেহি আত্মা/ কেরামন-কাতেবিন (আ.) নম্বরে red zone না green zone-এ যাবে। মালেক দারোগার অগ্নিজ্বালা,/ না জান্নাতুন-আদন মাল্য পাবে\ (বিধাতা জানে : পৃ-৪৭)।
কবি তাঁর এ কাব্যগ্রন্থে সামান্য কয়েকটি স্থানে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেও বাংলা শব্দ প্রয়োগে তাঁর যথেষ্ট মনযোগ রয়েছে। তিনি কবিতাগুলো লিখেছেন হয়ত একটি বিশ্বাসে। কিন্তু কোথাও তথ্যের বিচ্যুতি বা অতি ভাবাবেগ প্রয়োগ করেননি। তিনি মৃত্যুকে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছেন, মানব জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে। মৃত্যুতে মানব জীবনের সমস্ত নাটকের শেষ, এ কথা বলতে গিয়েও তিনি কোনো বিস্ময়বোধ করেননি বা কাউকে চমক দিতে চাননি। তিনি শুধু বলতে চেয়েছেন, বর্তমান এই উন্নততম Information Technology-এর যুগেও মানুষকে মৃত্যুর শেষ প্রহরে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। সুতরাং আমাদের এ পৃথিবীতে বেশী অহংকারী, সম্পদের বিলাসিতা বা দেমাগ করার কিছুই নেই। কারণ, এসব কোনো কিছুই সেই অজানা এয়ারপোর্টে দিয়ে যাবে না। যাবে কেবল রুহু নামের একটি বিশেষ অপার্থিব জিনিস।
কবিতাগুলো বেশ ভালো নিঃসন্দেহে। কবি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কবিতাগুলো লিখেছেন। এবার আমরা আশা করবো, জীবনের বিস্ময়বোধ নিয়ে কবি তাঁর তৃতীয় কাব্য আমাদের উপহার দেবেন।
প্রচ্ছদ করেছেন সোহানুর রহমান অনন্ত। প্রকাশ করেছে পারিজাত প্রকাশনী, ৬৮-৬৯ প্যারিদাস রোড, ঢাকা, ২০২০ বইমেলাতে। মূল্য ১৫০ টাকা। প্রচ্ছদ, মুদ্রণ ও অঙ্গসজ্জায় একটি পরিপাটি ভাব আছে। বইটির বহুল পাঠ কামনা করি।