সৈয়দ রফিকুল আলম : জ্যোতিঝরা অটল উল্লাস

করোনাকালের গদ্য : ৩৩

 

কবি সৈয়দ রফিকুল আলম। আমাদের সর্বজ্যেষ্ঠ বন্ধু। কবিতায় এক উদার অভ্যুদয় বিগত শতকের ষাটের গর্ভ থেকে। সেই ষাটের দশক, যার ধমনিতে সারাদেশজুড়ে কবিতার সুরের নাটকের চলচ্চিত্র আর সাংস্কৃতিক সাংগঠনিকতার, সর্বোপরি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬-দফার বিশাল বিস্ফার। কুলীন বাঙালিয়ানার উত্তাল উন্মীলন। এই ঐতিহাসিক উদ্ভাস সৈয়দ রফিকের মর্মে ত্বকে আর চাহনিতে। তাই প্রীতিময় প্রাণের গালিচা তাঁর শব্দের গ্রন্থিত-গ্রন্থিতে।

মাইকেলি আভিজাত্য আর সুধীন্দ্রীয় দার্ঢ়্য তাঁর কবিতাকে জনমনরঞ্জিনী হতে দেয়নি বটে তবে তার ঠিকরানো দ্যুতি আমাকে টেনেছে বরাবরই কাছে, খুব কাছে তাঁর। পেয়েছিও ঢের রাঙা স্নেহময়তা। একলগে বসে অ্যারিনমোর থেকে দামি তামাকি গন্ধে তাতার মিত্রতা পেতেছি উভয়ে। অনতিতরুণ বয়সেই আমি পেয়েছি তাঁর প্রশ্রয়ী পরানের পরাগ। কী করে ভুলি, সবুজআড্ডায় ছিপছিপে গড়নের এই কাব্যবোদ্ধা, দিলদার হাসিতে আমার কবিতার প্রশংসা করছেন বড়-বড় চোখের আমন্ত্রণে!

সৈয়দ রফিকুল আলম কি নিভৃতচারী? সেই ষাটেই যিনি লিখলেন ‘মুকুলের মাহফিল’, ‘কচিকাঁচার আসর’-এ ছড়া আর গল্প, কবি আহসান হাবীব ‘দৈনিক বাংলা’য় যাঁর কবিতা ছাপলেন, তিনি তো আসলে অভিমানী। এই অভিমান তো রাজসিক। রাজন্যে পুষ্পাহুতি মানায়, কোলাহল নয়।

দুই

ইংরেজি উর্দু হিন্দিতে চৌকস সৈয়দ রফিকুল আলম ভারি রোমান্টিক-সুন্দর। চলচ্চিত্রিক নন্দনে মধুবালা কি অড্রে হেপবার্ন-এ গভীর নিষিক্ত কবি যখন ‘মোগল-ই- আজম’ কিংবা ‘রোমান হলি ডে’-তে ওই রূপসীদ্বয়ের চারুহাসি আর বঙ্কিম গ্রীবাভঙ্গির সূক্ষ্ম ফর্দ তুলে আনেন- ভেসে যেতে ইচ্ছে করে। দূর চরাচরে। কোন্ স্বপ্নলোকে। এই নর্মতা, এই রম্যতা, এই রসসিক্ততা কবিরই একান্ত ধন। এই ধনঋদ্ধ কবি রফিক কবিতায় কিন্তু অত ঢলোঢলো নন।

তাঁর সবিশেষ রাজনৈতিক দোসর, এককালের কলামিস্ট, এখনকার প্রভাববলয়ী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে উৎসর্গিত কবিতাটার খানিকটে পড়ি তাহলে :

‘উদার কুসুমগুলো ঝরে পড়ে, দলনে মথিত হয়ে পচে
হৃদয়ে পাথরখানি ঘামে না এটুকু, আগ্রাসী বিকারে গ্রাস
আঁধার গিলেছে পথ, আত্মার নিপাতে উন্মূল চাষ
আজ কারা স্বর্ণতাজ পরে শিরে- মাধুকরী কল্পশ্লোক রচে…
(প্রগলভ, পুষ্পকরথ, পৃ. ৬২, সংখ্যা : ৮, ২০১৫)

বিগত শাসনে যুদ্ধাপরাধীবর্গের পৃষ্ঠপোষকমহল এখানে তাঁর নিক্ষিপ্ত শরে বিদ্ধ। কনক্রিট গাঁথুনিতে অভিনিবেশপ্রত্যাশী এই উচ্চারণ।

তিন

সৈয়দ রফিকুল আলম লিখেছেন যত, গ্রন্থধৃত হয়েছেন উন। বোধের শুকতারাসম খননেই কাল কেটেছে ঢের। বাংলা বনেদি ছন্দের সবক’টা অঙ্গন তাঁর বিস্তৃত মুঠোয় ঝরো-ঝরো হাসে অনুক্ষণ। সনেট মাত্রাবৃত্ত অক্ষরবৃত্ত স্বরবৃত্ত স্বরমাত্রিক মুক্তকগতি ও গদ্যভঙ্গিতে।

তাঁর তিন কাব্য : ‘বিশ্বাসের তরবারি অবিশ্বাসের কিংখাবে’, ‘শব্দের জলসিঁড়ি’, ‘জলের ভিতর কান্নার ধ্বনি’।

কবি সৈয়দ রফিকুল আলম আমার বিবেচনায় বিধৌত চৈতন্যে আর সৃষ্টির সম্ভারে এক জ্যোতিঝরা, অটল উল্লাস।

 

হাফিজ রশিদ খান
২২/৮/২০২০
দক্ষিণ শুলকবহর চট্টগ্রাম

Print Friendly

Related Posts