রেজাউল করিম রেজা: বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে নৃত্যশিল্পীদের জীবনে এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান না থাকায় আয় নেই অনেকেরই। করোনাকালে শিল্পীরা নিজ নিজ ঘরে নৃত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। বসে নেই প্রশিক্ষকরাও। শিক্ষা উপকরণ বানিয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবে দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পীরা নৃত্যের ভিডিও করে ভক্তদের সঙ্গে শেয়ার করছেন। করোনার এই প্রকোপ এমন সময়ে আঘাত হেনেছে, যখন বাঙালিদের জন্য অনেকগুলো বড় উৎসব পর পর অপেক্ষায় ছিলো। যেমন- জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, পহেলা বৈশাখ, কবীগুরুর জন্মবার্ষিকী, ঈদ, জন্মাষ্টমীসহ আরও বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠান। যার সবই বন্ধ রয়েছে করোনার কারণে। নেই বিবাহের গায়ে হলুদের জমজমাট পারিবারিক নাচ-গানের মতো অনুষ্ঠানও। প্রতিটি সেক্টরের মতো নৃত্যশিল্পীদেরও অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে এই করোনায়। অনেক নৃত্য প্রশিক্ষক আছেন, যারা করোনার কারণে তাদের স্কুল ও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। দেখা গেছে, অনেক নৃত্য শিক্ষক স্কুলে ও বাসায় নৃত্য শিখিয়ে যে সম্মানী পান তা দিয়ে সংসার চালান। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। অনেকে কয়েক মাস ধরে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, বাসা ভাড়া দিচ্ছেন ঘরে বসে থেকে।
করোনার এমন পরিস্থিতিতে কেমন চলছে নৃত্যশিল্পী বা প্রশিক্ষকদের জীবন? বর্তমানে নৃত্যর স্কুল বন্ধ থাকায় বাসায় কি করছেন নৃত্যশিল্পীরা? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক অনন্যা ওয়াফি রহমানের সঙ্গে।
অনন্যা বলেন, ‘বর্তমানে এমনিতে অনেক অনলাইন নৃত্য প্রতিযোগিতায় ভারত ও বাংলাদেশের বিচারক হিসেবে কাজ করছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাইভ এ আমন্ত্রণে আলাপ করছি। আর সবচেয়ে বেশি মিস করছি আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের, সহকর্মীদের। আসলে সারাদিন কাজ করে সময় যায়। কিন্তু বর্তমানে ঘর বন্দি, তাই সময় যেন কাটে না। তবুও প্রার্থনা করি যেন এই যুদ্ধ থেকে দ্রুত মুক্তি পাবো, এটাই বিশ্বাস রাখি। এ বছরতো অনেক অনুষ্ঠান ছিল মুজিব জন্মশতবর্ষ, ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, নজরুল জন্মজয়ন্তী, ঈদ অনুষ্ঠান আরও অনেক অনুষ্ঠান, তার কিছুই হলো না! তবে অবস্থা ভালো হলে যে আবার অনুষ্ঠান করতে পারবো তা ঠিক বলতে পারছি না, কারণ বর্তমানে সবাই খুব আতঙ্কে আছে।’
অনন্যা বলেন, ‘আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে নাচ একটা বিশেষ অংশ জুড়েই আছে। প্রতিটি মানুষেরই কিছু স্বপ্ন বা লক্ষ্য থাকে। নাচ নিয়ে কিছু একটা করা ও আমার স্বপ্ন এবং লক্ষ্যই বলতে পারেন। তাই সাধনার মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ ও লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, করবো। তাছাড়া অনেক কবি লেখক বলে থাকেন যে জীবনের প্রথম প্রেম কখনওই ভোলা যায় না। আমার কাছে নাচই হচ্ছে আমার প্রথম প্রেম। তাই সব সময় নাচের সঙ্গে থাকব। কারণ মনতো জড়িয়ে আছে নাচের সঙ্গেই।’
নৃত্য শব্দটি সাধারণত দেহভঙ্গীর মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশকে বোঝায়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা মনোরঞ্জন ক্ষেত্রে দেখা যায়। গীতবাদ্যের ছন্দে অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মঞ্চে চিত্রকল্প উপস্থাপনের ললিত কলাই নৃত্য বা নাচ। নৃত্যকলার সংজ্ঞা নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতত্ত্বিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর।
অনন্যা জানান, তিনি নাচ নিয়ে তৃপ্ত। সব সময় সমকালীন ধারায় চর্চা করেন। মানুষের সামনে নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারলে ভালো লাগে তাঁর। যখন থেকে কোনো উৎসবে যোগ দেবেন বলে মনস্থির করেছেন, তখন থেকেই সেখানকার দর্শক-শ্রোতাদের জন্য নতুন কিছু দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করেন বলে জানান তিনি।
অনন্যা ওয়াফি রহমান বলেন, ‘নাচের কিছু নির্দিষ্ট কৌশল আছে এবং থাকে। এ বাইরেও শিল্পীর নিজস্ব কোনো না কোনো কৌশল আছে। অনেক সময় সে কৌশল মুখ্য নয়, বরং নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপনা করাই হচ্ছে একজন প্রকৃত শিল্পীর কাজ। আর সব সময় সেটাই করে আসছি।
অনন্যা বলেন, বিভিন্ন দেশে মানুষের ভাষা ভিন্ন হতে পারে, তবে নাচের ভাষা প্রায় অভিন্ন। উৎসব ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। রীতি ও কৌশল রপ্তের মধ্য দিয়ে ভিনদেশি উৎসবের মাত্রা-তাল-লয়-রস উপস্থাপন করা খুব সহজ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে অনন্যা বলেন বলেন, ‘একই জিনিস সব সময় সবার ভালো লাগে না। লাগার কথাও নয়। ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা সবার জন্যই মঙ্গলজনক, এতে করে যিনি নাচেন তিনি তৃপ্তবোধ করেন। আবার যিনি বা যারা দেখেন, তারাও বৈচিত্র্যময়তায় পুলকিত হন।’
অনন্যা বলেন, করোনার জন্য সব কিছু থেমে গেলেও সৃষ্টিশীল মানুষরা কাজ করে চলেছি। করোনার প্রথমদিকে ভয়, অস্থিরতা কাজ করছিল। কিন্তু আমি নৃত্য শিল্পী মানুষকে আমার শিল্পের মাধ্যমে আনন্দ ও সস্তি দেয়াই আমার কাজ। তাই করোনাতে নৃত্যের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। এতে মন ও শরীর দুই-ই ভালো থাকে। ঘরে থেকে নাচের ভিডিও আপলোড করেছি। শুরু করে দিয়েছি অনলাইনে ছাত্র-ছাত্রীদের নাচের ক্লাস নেয়া। জানি দর্শকের সাথে সরাসরি কানেকশন না হলে কোন শিল্পীরই পরিতৃপ্তি আসে না। যা মঞ্চেই সম্ভব। কিন্তু এই দুঃসময়ের পরিস্থিতির জন্য ঘরে বসেই কাজ করে যেতে হচ্ছে, হয়তো লম্বা সময় এভাবে চলতে হবে। চর্চা করে যেতে হবে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে সুন্দর ও সুস্থ নাচের অঙ্গন গড়ে ওঠবে।
উল্লেখ্য, অনন্যা ওয়াফী রহমান একজন প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যশিক্ষক। ১৯৮৪ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই নাচের স্কুল বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শিশু শিল্পী প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুড়ি’তে কত্থকনৃত্যে তৃতীয় ও সাধারণ নৃত্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে কত্থক নৃত্যের উপর আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে দিল্লীর শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রে যান। সেখানে গুরু শিখা খের ও পদ্মবিভূষণ উমা শর্মা জির কাছে তালিম নেন। এবং সে বছরেই ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি ভবনে গুরু শিখা খের পরিচালনায় কত্থকনৃত্য পরিবেশনা করে প্রশংসা কুড়ান। দিল্লীতে শেখা অবস্থায় পদ্মবিভূষণ পন্ডিত বিরজু মহারাজের কাছে দ্বিতীয়বার ওয়ার্কশপের মাধ্যমে কত্থকনৃত্যের তালিম নেন। এরপর চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভাস্কর ডিগ্রী লাভ করেন। ২০০৪ সালে দিল্লীর শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্র হতে কত্থকনৃত্যের উপর পোস্ট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। বর্তমানে নৃত্যমঞ্চ ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নৃত্য শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। অনন্যার বাবা ওয়ালীউর রহমান রেজা বীর মুক্তিযুদ্ধা (সাবেক সংসদ সদস্য বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক গণপরিষদ সদস্য), মা চিত্রশিল্পী সুজাতা রহমান।
অনন্যার মতে শিল্পের সাধনার শেষ নেই। শিল্পর মধ্য দিয়েই শিল্পীর বেচে থাকা। তাই নৃত্যের উপর উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে শিল্পী হিসেবে নৃত্যকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং সমাজে সন্মানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এটাকে তিনি অনেক বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন। আমি নৃত্য শিক্ষক হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর মধ্যে নৃত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা আগামিতে নৃত্য সাধনায় অবিচল থেকে সুস্থ ও সুন্দর নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই তার প্রত্যাশা।