লুইজ ক্লুখ এর নোবেল বক্তৃতা

রহমান হেনরী
যখন ছোট্ট শিশু ছিলাম, মনে হয়, পাঁচ কি ছয় বছরের, আমার ভাবনার ভিতর একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম, বিশ্বের মহোত্তম কবিতা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার প্রতিযোগিতা। চূড়ান্তে নির্বাচিত হয়েছিলো দু’টি: ব্লেইকের ‘‘দ্য লিটল ব্ল্যাক বয়’’ এবং স্টিফেন ফস্টারের ‘’সোয়ানি রিভার’’।
গুটিগুটি পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিলাম আর দ্বিতীয় শোবার ঘর পেয়েছিলাম লং আইল্যান্ডের সাউথ শোরের ছোট্ট এক গ্রাম সিডারহার্স্টে, আমার দাদিমা’র বাড়িতে, উচ্চারণ করে নয়, মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম, যেমনটি আমার পছন্দের, ব্লেইকের অবিস্মরণীয় কবিতা, এবং মনে মনেই, গাইছিলামও, সেই ভূতুরে, ফস্টারের নিঃসঙ্গ গান। কীভাবে ব্লেইকের কবিতা পড়ে ফেলেছিলাম সে এক রহস্য।
মনে হয়, আমার পিতৃনিবাসে প্রচলিত রাজনীতির আর ইতিহাসের এবং অজস্র উপন্যাসের ভিড়ে সামান্য কিছু কাব্য-সংকলনও ছিলো। তবে ব্লেইকে মজেছিলাম আমার দাদিমা’র বাড়িতে। দাদিমা বই পড়ুয়া মে’ ছিলেন না। কিন্তু ওখানে ব্লেইক ছিলো, দ্য সংস অব ইনোসেন্স এন্ড দ্য এক্সপেরিয়েন্স, এবং শেক্সপীয়রের নাটকে ব্যবহৃত গানসমূহের একটা চিলতে সংকলন গ্রন্থও, সেসবের অনেকগুলো আমি মুখস্থ করেছিলাম। নির্দিষ্ট উল্লেখে বলতে গেলে সিম্বিলিনের গান খুব মনে ধরেছিলো, সম্ভবত একটা শব্দও বুঝতে পারিনি কিন্তু সুর, সুরের মূর্ছনা, বেজে ওঠা বাণী শুনে, এক নিষ্প্রভ, ভীতু শিশুমন রোমাঞ্ছিত হচ্ছিলো।
‘‘এন্ড রিনাউন্ড বি দাই গ্রেইভ’’। আশা করি (বাণীটা এটাই ছিলো)।
সম্মানিত করতে, উচ্চ মার্গীয় পুরস্কার দিতে, এ ধরনের প্রতিযোগিতা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়; ওইসব পুরানের কাহিনী যেগুলো আমার প্রথম পাঠ্য ছিলো সেগুলোও এমন প্রতিযোগিতায় ঠাঁসা। এমনকী যখন আমি অতি তরুণ ছিলাম, বিশ্বের মহোত্তম কবিতা নির্বাচনকেও আমার মনে হয়েছিলো, উঁচুর চেয়েও উচ্চতর সম্মাননা প্রদান করা। এটা সেই পদ্ধতিও যেভাবে আমি ও আমার বোন বেড়ে উঠছিলাম, ফ্রান্সকে বাঁচাতে (জোয়ান অব আর্ক), রেডিয়াম আবিষ্কারের লক্ষে (মেরি কুরি)।
পরবর্তীকালে আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম উঁচুশ্রেণির কিছু হবার ভাবনার বিপদ ও সীমাবদ্ধতাসমূহ, কিন্তু আমার শৈশবে একটা কিছু পুরস্কার দেবার ব্যাপারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিলো। একজন পাহাড়ের শীর্ষরদেশে দাঁড়াবে, দূর থেকেও দৃশ্যমান, পর্বতময় একমাত্র আগ্রহের মানুষ। একটু নিচে দাঁড়ানো মানুষটা দৃষ্টির আড়াল।
কিংবা, এ ক্ষেত্রে কবিতা। আমি নিশ্চিত অনুধাবন করতাম যে বিশেষত ব্লেইক কোনওভাবে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতেন, এর চূড়ান্ত রূপায়নে তার পরিকল্পনা ও অভিপ্রায় থাকতো। বুঝতে পারতাম তিনি মৃত, কিন্তু অনুভব করতাম এখনও সপ্রাণ তিনি, যখন শুনতে পেতাম তার কণ্ঠস্বর কথা বলছে আমার সাথে, ছদ্মবেশী, কিন্তু তারই কণ্ঠস্বর। কথা বলছে, অনুভব করতাম, শুধুই আমার সাথে কিংবা বিশেষভাবে আমার সাথে। অনুভব করতাম বিচ্ছিন্ন একক হচ্ছি, সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছি; আমি এও অনুভব করতাম ব্লেইকই সেইজন যার সাথে কথা বলতে বিশেষ আগ্রহী আমি, তার সাথে, শেক্সপিয়রসহ, ইতোমধ্যেই বাতচিত চালিয়ে যেতাম।
সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ছিলেন ব্লেইক। কিন্তু পরে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম পদ্য দু’টি কত সাদৃশ্যপূর্ণ; চিত্রিত হতাম, এখনকার মতই তখনও, নির্জতা ও নৈঃসঙ্গ্যের মানবিক কণ্ঠস্বরে, আকুলতা বা বিলাপে ধ্বনিত। এবং যতই বেড়ে উঠছিলাম ফিরে যাচ্ছিলাম ওইসব কবির কাছে, নির্বাচিত শ্রোতা হিসেব, যাদের কবিতায় আমি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতাম। আন্তরিক, লোভজাগানিয়া, প্রায়শই সংক্ষুব্ধ আর অন্তর্মুখি। সমাবেশের কবিগণ নন। ওইসব কবি নন যারা আপনাতে আপনি মাতোয়ারা।
এই আবদ্ধতা পছন্দ করতাম আমি, এই ধারণাটি আমার পছন্দ হতো যে কবিতাটি যা বলছে তা দরকারি এবং ব্যক্তিগতও, বার্তাটি যাজক বা বিশ্লেষক কর্তৃক ধারণীয়।
ব্লেইক আমার সাথে কথা বলছিলেন সেই ছোট্ট কৃষ্ণ বালকটির মধ্য দিয়ে; তিনি ছিলেন ওই কণ্ঠস্বরটির অন্তর্লীন জ্ঞাতি-পরম্পরা। তাকে দেখা যেতো না, ঠিক যেমন ছোট্ট কৃষ্ণ বালকটিকে দেখা যাচ্ছিলো না, কিংবা দেখা যাচ্ছিলো ভুলভালরূপে, অনর্থকতায় এবং হেয় শ্বেত-বালকটির অবয়বে। তবে আমি জানতাম যে সে যা বলছে তা সত্য, জানতাম যে তার অস্থায়ী নশ্বর দেহ ধারণ করছে জ্যোতির্ময় বিশুদ্ধতার এক আত্মা; জানতাম কেননা সেই কৃষ্ণ বালক যা বলছে, তার অনুভূতির এবং তার অভিজ্ঞতার বিবরণ, কোনও দোষারোপ নেই, নিজের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের বাসনা নেই, শুধু রয়েছে সেই আস্থা যে, তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মৃত্যুর পর প্রকৃত পৃথিবীতে, সে যা তার জন্যই তাকে স্বীকৃতি দেয়া হবে, এবং আনন্দের এক আতিশয্যে অধিকতর নশ্বর শ্বেত বালকটিকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি থেকে রক্ষা করা হবে। জানতাম যে এটা বাস্তবসম্মত আশা নয়, জানতাম যে এটা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, এসবই কবিতাটিকে করে তুলছে হৃদয়বিদারক এবং গভির রাজনৈতিকও। সেই আঘাত ও যৌক্তিক ক্রোধ অনুভবে নিজেকে অনুমোদন দিতে পারে না, তার মা তাকে যেসব থেকে সুরক্ষিত করতে চাইছে, পাঠক বা শ্রোতার কাছে সেটি অনুভূত হয়। এমনকি তখনও যখন সেই পাঠকও এক শিশু।
কিন্তু প্রকাশ্য জনসম্মাননা অন্য ব্যাপার।
যেসব কবিতার কাছে, সারাজীবন, উৎকৃষ্টরূপে চিত্রিত হয়েছি আমি সেসব এরকম কবিতা যেমনটি বর্ণনা করলাম, অন্তরঙ্গ নির্বাচন বা মিলনের কবিতা, সেইসব কবিতা যাতে শ্রোতা বা পাঠক অত্যাবশ্যক অবদান যোগ করে, আত্মবিশ্বাস বা হৃদয়মথিত চীৎকারের গ্রহিতাস্বরূপ, মাঝেমাঝে সহ-ষড়যন্ত্রকারী রূপে।
‘‘আমি কেউ না,’’ ডিকিন্সন বলছে। ‘‘অব্যক্তি, তুমিও?/তবে তো আমাদের একটা যুগল থাকলো— এমন বোলো না/…’’ অথবা এলিয়ট: ‘‘চলো কবে, তুমি আর আমি দু’জনায়/সন্ধ্যা যখন মেলেছে শরীর আকাশ-সীমানায়/নিথর রোগীর শরীর যেমন টেবিলে ছড়িয়ে যায়…’’ এলিয়ট বয়স্কাউট বাহিনীকে তলব করছেন না। তিনি পাঠকবর্গকেই কিছু একটা করতে বলছেন। যেমন এর বিপরীতরূপে, বলা, শেক্সপিয়রের ‘‘তোমাকে কি একটি গ্রীষ্মদিনের সাথে উপমিত করবো আমি’’ শেক্সপিয়র আমাকে গ্রীষ্মদিনের সাথে উপমিত করছেন না। আলোকোদ্ভাসনের এক শিল্পগুণ শ্রবণে অনুমতিপ্রাপ্ত হচ্ছি আমি, কিন্তু আমার উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না কবিতাটির।
যে ধরণের শিল্পশৈলীতে আমি আকৃষ্ট হতাম, তা সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বা রায়, সেগুলো বিপজ্জনক। অন্তরঙ্গ কথনের অনিশ্চয়তা তাকে ক্ষমতায়িত করে আর তাতে যুক্ত করে পাঠককে ক্ষমতায়িত করা, সেই পাঠকের যার মাধ্যমে কবিতার কণ্ঠস্বরটির আকুলতা বা আত্মবিশ্বাস উৎসাহিত হয়।
এ ধরণের একজন কবির ক্ষেত্রে, সে নারীই হোক বা পুরুষ, কী ঘটে সমষ্টি যখন তাকে সাধুবাদ জানানো ও বিবর্ধিত করার বদলে দৃশ্যত উপেক্ষা করে বা নির্বাসিত করে? আমি বলবো কবি তখন সন্ত্রন্তবোধ করে, শঠতা ও চাতুর্যের কাছে পরাস্ত হয়। এটাই ডিকিন্সনের বিষয়বস্তু। সর্বদাই নয়, তবে প্রায়শই।
যখন তারুণ্যে ছিলাম, এমিলি ডিকিন্সনকে খুব আবেগ দিয়ে পাঠ করেছি। সাধারণত গভীর রাতে, ঘুমোতে যাবার সময় পেরোলে, বসার ঘরের সোফায়।
আমি কেউ না। তুমি কে?
অব্যক্তি, তুমিও?
এবং, কবিতাটির এ সংস্করণে তারপর পড়েছি এবং এখনও অগ্রগণ্য করি:
তবে তো আমাদের একটা জুটি থাকলো— এমন বোলো না!
ওরা নির্বাসন দেবে আমাদের, তুমি জানো…
ডিকিন্সন আমাকে বেছে নিয়েছিলো বা স্বীকৃতি দিয়েছিলো, যখন সোফায় বসে থাকতাম। আমরা ছিলাম অভিজাত, দৃষ্টির আড়ালের সঙ্গী, শুধু আমাদের জানা ছিলো এক সত্য, যা একে অপরের জন্য প্রতিপন্ন করতাম।
কিন্তু আমাদের নিরাপদ বসার আসনে অন্যদের প্রবেশাধিকারকে বারিত করা হবে কি দিয়ে? নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতো যখন আসনটি স্থানান্তরিত হতো অন্য কোনও ভুবনে।
আমি এখানে এক কিশোরী মেয়ের উপর এমিলি ডিকিন্সনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কথা বলছি না। একটা মেজাজের কথা বলছি যা জনজীবনকে অবিশ্বাস করে কিংবা এটাকে এমন একটা সাম্রাজ্য হিসেবে দেখে যে সাধারণীকরণ নির্ভুলতাকে নস্যাৎ করে, আংশিক সত্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করে অকপটতাকে এবং সত্যের প্রকাশকে অভিযুক্ত করে। সম্প্রসারিত করে বললে: ধরুন সেই উস্কানিমূলক কণ্ঠস্বর, ডিকিন্সনের কণ্ঠ, বিচারসভার কণ্ঠে প্রতিস্থাপিত হয়। ‘‘আমরা কেউ নই, তোমরা কারা?’’ কবিতার বার্তাটি অকস্মাৎ দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে।
এ যাবৎ যে ধরণের আতঙ্কের কথা বর্ণনা করে আসছি সেই একই ধরণের আতঙ্ক অনুভব করে ৮ অক্টোবর সকালে আমি অবাক হলাম। সেই আলোটা ছিলো অতি উজ্জ্বল। পরিমাপকটার বিস্তৃতি বিশাল।
আমরা যারা বই লিখি সম্ভবত অনেকের কাছে পৌঁছানোর ইচ্ছা রাখি। কিন্তু কিছু কিছু কবি স্থানিক অর্থে অনেকের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারটাকে দেখে না, যেমনটা জমজমাট মিলনায়তনে। অনেকে পৌঁছানোর ব্যাপারটাকে তারা দেখে অস্থায়ীভাবে, ধারাবাহিকতায়, অনেক অতিক্রান্ত কালে, ভবিষ্যতে, কিন্তু কোনও এক গভীর উপায়ে এসব পাঠক আসে একক হয়ে, এক এক করে।
আমি বিশ্বাস করি যে আমাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করে, সুইডিশ একাডেমি ওইসব অন্তরঙ্গ, ব্যক্তিগত কণ্ঠকে সম্মানিত করার উপায় বেছে নিচ্ছে, যাদেরকে গণকণ্ঠ মাঝেসাঝে প্রসারিত বা প্রবর্ধিত করতে পারে, কিন্তু প্রতিস্থাপিত করতে কখনও পারে না।
লুইজ ক্লুখ

২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতলেন আ্যামেরিকান কবি অধ্যাপিকা লুইজ ক্লুখ৷ মার্কিন সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ এর ফলে ইতাহাসে ১৬তম নারী হিসেবে নোবেল পেলেন লুইজ ক্লুখ৷ ১৯৯৩ সালে নোবেল পাওয়া বিখ্যাত উপন্যাসিক টনি মরিসনের পর এই প্রথম কোনো অ্যামেরিকান নারী সাহিত্যিকের এ সম্মাননা লাভ৷ নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, লুইজ ক্লুখ হলেন অ্যামেরিকার বর্তমান সাহিত্যজগতের সেরাদের অন্যতম মার্কিন সাহিত্যে লুইসের অবদানের বিষয়ে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান আন্ডেরস ওলসন বলেন, ‘‘তাঁর লেখায় রয়েছে রসবোধের তীব্র উপস্থিতি, সরলতা, আর দৃঢ়তা৷”

১৯৪৩ সালে নিউইয়র্কে জন্ম নেয়া এ কবি লঙ সারা লরেন্স কলেজ, উইলিয়াম কলেজ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাব্যকলা পড়িয়েছেন৷ বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা (অ্যাডজাঙ্কট)৷ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ফার্স্টবর্ন৷ এ বইয়ে তাঁর লেখার ছন্দ আর সাহিত্যবোধের যে প্রকাশ তার প্রশংসা করতে ভোলেনি নোবেল কমিটি৷

এ পর্যন্ত ১২টি কবিতার বই প্রকাশের পাশাপাশি প্রবন্ধও লিখেছেন লুইজ ক্লুখ৷ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ এবং ‘ফেইথফুল ও ভার্চুয়াস নাইট’৷ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত কবিতার বই ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ তাকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার৷ তাঁর লেখায় দেখা মেলে পারিবারিক জীবন, বাল্যকাল আর গ্রীক-রোমান পৌরাণিক কাহিনীর সাবলীল ও নান্দনিক প্রকাশ৷

 

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts