জসীম উদদীন লোকজীবনের রূপায়ক

শাহ মতিন টিপু

 

শুরু হলো নতুন বছর ২০২১। বছরের প্রথম দিনটি কবি জসীম উদ্দীনের জন্মদিন। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। বাবা পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন আর মা আমিনা খাতুন গৃহিনী।

জসীম উদ্দীনের শিক্ষাজীবন ফরিদপুরে শুরু হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম এ পাশ করেন। খুব অল্প বয়সেই লেখালেখির প্রতি অন্তপ্রাণ ছিলেন তিনি।

একাধারে তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও লেখক। তিনি আবহমান বাংলাকে তিনি তার কবিতায় তুলে এনেছেন। এ কৃতিত্বের জন্যই তিনি পল্লীকবি উপাধিতে ভূষিত হন। তার ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ১৯৪০ সালের মধ্যেই একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পের গ্রন্থ হিসেবে অনূদিত হয়।

জসীম উদদীনের অধিকাংশ রচনায় দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, রাখালের প্রতি তার অসম্ভব মমতা লক্ষ্য করার মতো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের মানুষের যাপিত জীবন অসামান্য দরদে উপস্থাপন করেছেন। তিনি সবসময় সহানুভূতিশীল ছিলেন নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি।

পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সহ সভাপতি ড. গস্কোওস্কির আমন্ত্রণে জসীম উদদীন সোভিয়েত রাশিয়া যান। কবির নিজের ভাষায়, ‘সারাজীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি। তাহাদের সুখ, দুঃখ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, লইয়া কবিতা উপন্যাস লিখিয়াছি। আমার খুব বড় স্বপ্ন ছিল একবার সোভিয়েত দেশে যাইব। সে দেশের রাষ্ট্র কিভাবে তার জনগণকে সব চাইতে বড় আসন দিয়াছে ও কূপমণ্ডুকতা হইতে মুক্ত করিয়া উপরে তুলিয়া ধরিয়াছে’।

লেনিন, সোভিয়েত দেশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিলো। সোভিয়েতের সেই ব্যবস্থা দেখে কবি বলেছেন, ‘ইস্ আমার বাংলাদেশে যদি এমন ব্যবস্থা থাকতো সকলে সোভিয়েত দেশের মতো সুখে থাকতো’।

জসীম উদ্দীন ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ি তাকে কবর দেওয়া হয়েছে ফরিদপুরে প্রিয় দাদির কবরের পাশে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক প্রবন্ধে লিখেন- তার কাব্যের আবেগের, ভাষার চিত্রকল্পের অকৃত্রিমতা মন জয় করে নিলো আধুনিকমনা বাঙালি পাঠকের, বিদগ্ধ ইউরোপীয়দের। জসীম উদ্দীনের আবির্ভাবের পর আধুনিক বাংলা কবিতার কোনো যোগ্য সঙ্কলনে তাকে অবহেলা করা অসম্ভব ছিলো। (জসীম উদ্দীন: মানুষ ও কবি)

দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন- জসীম আমাদের গ্রাম্য জীবনকে তার তুলির আঁচড়ে মূর্ত করে তুলেছে, এবং যারা ছিল সমাজের মধ্যে অপাংক্তেয় তাদের জীবনের চিত্রকে ভদ্র জীবনের সামনে জীবন্ত করে পেশ করেছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের লোকজীবনের রূপায়ক জসীম উদদীন। পল্লীবিষয়ক কবিতার রচয়িতা তিনি- এ কথা সত্য। কিন্তু, এই দেশের মা-মাটি মানুষের প্রকৃতিগত জীবন তার হাতে রূপ পেয়েছে অনন্যভাবে। সেই সঙ্গে তার জীবন ও কর্ম আধুনিক সাহিত্যেরই অংশীদার।

Print Friendly

Related Posts