বিডি মেট্রোনিউজ ॥ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বাজার বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার। পুরোটাই আমদানি নির্ভর। প্রায় সবটাই আসে চীন থেকে। এর ফলে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ন তথ্য চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। অথচ দেশেই তৈরি হতে পারে মোবাইল ফোন। এজন্য বিনিয়োগকারীদের প্রস্তুতিও রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা বিদ্যমান শুল্কনীতি।
সম্পূর্ন (সিবিইউ বা কমপ্লিট বিল্ড আপ) মোবাইল ফোন আদমানিতে ভ্যাট, কাস্টমস, এআইটিসহ শুল্ক দিতে হয় ২৩.৭৫ শতাংশ। কিন্তু দেশে মোবাইল ফোন তৈরি করলে কাঁচামাল এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ। সব কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশের গড় শুল্ক দাঁড়ায় ৩৭ থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ সম্পূর্ন তৈরি মোবাইল ফোন আমদানির তুলনায় কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি করলে শুল্ক দিতে হয় প্রায় দ্বিগুন। এজন্য বাংলাদেশে কেউ মোবাইল ফোন তৈরি করে বিপুল ক্ষতির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
অথচ দেশেই তৈরি হতে পারে উচ্চ প্রযুক্তির মোবাইল ফোন সেট। তাতে একদিকে যেমন বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে মোবাইল ফোন রপ্তানিও সম্ভব। সেইসঙ্গে এ খাতে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে দক্ষ জনবল। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক ব্যাকওয়ার্ড শিল্পও গড়ে উঠবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ কোটিরও বেশি মোবাইল সেট ব্যবহৃত হয়। বলা হয়ে থাকে ৬ কোটির মতো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমদানি করা নি¤œ মানের মোবাইল সেট কিনে প্রায়ই প্রতারনার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। অথচ দেশেই তৈরি হতে পারে উন্নতমানের মোবাইল ফোন সেট।
জানা গেছে, মোবাইল ফোন তৈরি করতে প্রায় ৯০ টি কাঁচামাল প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে যার বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। বর্তমান কর কাঠামোতে মোবাইল ফোন তৈরির প্রয়োজনীয় মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হবে সর্বনিম্ন ৩১.৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে ব্যাটারি আমদানিতে ৫৩.৩৫ শতাংশ, পিসিবি (প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড) বা মাদারবোর্ডে ৩১.৫০ শতাংশ, এলসিডি ডিভাইসে ৩১.৫ শতাংশ, ইয়ারফোনের উপর ৫৩.৩৫ শতাংশ এবং স্ক্র ভয়েড স্টিকার আমদানিতে প্রায় ৯৫ শতাংশ কর দিতে হয়।
সম্প্রতি এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনপত্র দিয়েছে প্রস্তাবিত কম্পিউটার এ্যান্ড মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন। তাদের আবেদনে এই শিল্পের অনকূলে এসআরও (স্ট্যাচুটরি রেগুলেটরি অর্ডার) জারির মাধ্যমে দশ বছরের জন্য শুল্ক রেয়াত চাওয়া হয়েছে। দাবি করা হয়েছে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌলিক কাঁচামাল এবং যেসব যন্ত্রাংশ প্রাথমিকভাবে দেশে উৎপাদন সম্ভব নয় তার উপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি প্রদানের। সেইসঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরোপনীয় মূল্য সংযোজন প্রত্যাহারের দাবিও তুলে ধরা হয়েছে।
উল্লিখিত এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ফাহিম রশিদ জানান, কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন তৈরির চিন্তা ভাবনা করছে। তাদের কেউ কেউ অবকাঠামো নির্মাণ এমনকি কিছু মেশিনারিজ স্থাপনও করেছেন। বর্তমানে ডিজাইন এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এর কাজ হচ্ছে দেশেই। পূর্নাঙ্গ কারখানার জন্য তারা এখন সরকারের নীতি সহায়তার প্রত্যাশায়।
সরকার ইতিপূর্বে প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করে কম্পিউটার, মডেম, সফটওয়্যার, মনিটর ইত্যাদি আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর রহিত করেছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, মোবাইল ফোন উৎপাদন পর্যায়ে মৌলিক কাঁচামালের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার এবং অন্যান্য শুল্ক প্রত্যাহার করে এই শিল্পে দেশকে স্বয়সম্পূর্ন হওয়ার সুযোগ দেয়া হোক।
গত ১৬ মে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি। ‘দেশীয় উদ্যোগে মোবাইল ফোন শিল্প গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়‘ শীর্ষক আলোচনায় বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, এই খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত শুল্কহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। বিনিয়োগের সুরক্ষা ও আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক বাড়াতে হবে। ওই আলোচনায় শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, সরকার এ খাতের বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য শিল্পবান্ধব শুল্ককাঠামো নিশ্চিত করবে।
আলোচনায় আইসিটি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বলেন, আমরা কি চিরকালই আমদানি নির্ভর থাকব? এখন সময় হয়েছে আমদানিকারক থেকে উৎপাদকে পরিণত হওয়ার। সেক্ষেত্রে ফিনিশড প্রোডাক্টের উপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হোক এবং কাঁচামালের উপর আমদানি শুল্ক ও কর শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হোক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জানান, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে আসন্ন বাজেটে সব ধরণের কৌশল গ্রহণ করা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান ১৫ মে সাংবাদিকদের বলেন, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় সরকার সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখবে।
সংশ্লিষ্টদের এসব কথায় ব্যবসায়ীরা আশাবাদি। তারা বলছেন, সরকার প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বান্ধব নীতি সহায়তা দিলে খুব শিগগীরই দেশে মোবাইল ফোন সেট তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে।