অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে, রাজধানী ঢাকায় অনেক কিছুর মতোই উচ্চদামের পাঠ্যবই ভাড়া দিয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। ফুল সেমিস্টারের জন্য দোকান থেকে ভাড়া নিয়ে বই পড়তে পারবেন যে কোনো শিক্ষার্থী।
ঢাকার নিউমার্কেট সংলগ্ন নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারে কিছু দোকানে পাবেন এই সুবিধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের কোল ঘেঁষে নীলক্ষেত বই বাজারের অবস্থান।
জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ইউরোপিয়ানরা বাংলার বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষ করত। ১৮৪৭ সালে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। সেই সময় ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার বিরাট প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ হতো। সেই থেকে নীলক্ষেতের নামের সঙ্গে নীল শব্দটি জড়িয়ে রয়েছে। সে নীলক্ষেতের খ্যাতি এখন বইয়ের বাজার হিসাবে। নীলক্ষেত বললেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ঘরে বাইরে সাজিয়ে রাখা থরে থরে বই। হেনো কোনো বই নেই যা নীলক্ষেতে পাওয়া যায় না।
নীলক্ষেত থেকে নিয়মিত পুরাতন বইয়ের ভাড়া নেন এমন একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত। আলাপকালে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, আমি নিয়মিত নীলক্ষেত থেকে পুরাতন বই সংগ্রহ করি। সেটা একাডেমিক বা বাইরের- যা হোক। এছাড়াও এমন অনেক বই আছে যা নতুন পাওয়া যায় না। এখান থেকে বই নিলে আবার সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলে সেই বই জমা দিয়ে সামান্য কিছু টাকা যোগ করে নতুন সেমিস্টারের বই নেওয়া যায়। এটাকে এক প্রকার ভাড়ায় বই পড়া বলতে পারেন।
ইডেন মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাফসানা কবির রাইজিংবিডিকে বলেন, আমাদের মতো হিসেবি মধ্যবিত্তের মানসিক আনন্দের অপার উৎস নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান। যা আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমি প্রথম একজন বড় আপুর মাধ্যমে জানতে পারি এখানে সিলেবাসে আছে এমন পুরাতন বই দিয়ে পরবর্তী নতুন সেমিস্টারের বই নেওয়া যায়। তারপরও থেকে এখন পর্যন্ত আমি পুরাতন বই দিয়েই পড়াশোনা করছি। এছাড়াও আমি নীলক্ষেতে গেলে পুরনো বইয়ের বাজারে একটু ঢু মেরে আসি, কারণ পুরনো বইয়ের গন্ধ শুঁকতেই যেনো ভালো লাগে আমার।
ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আল হাসিব রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ঢাকা কলেজের সাথে নীলক্ষেতের একটি আলাদা সম্পর্ক আছে। এখানে নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরাতন বইও পাওয়া যায়। আমি সেই দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই নীলক্ষেতের পুরাতন বই নিয়ে পড়াশোনা করছি। এমনকি চাকরির পুরাতন বইও পাওয়া যায় এখানে। নীলক্ষেতের এই পদ্ধতিটি আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।’
নীলক্ষেতের পুরোনো বই বিক্রেতা শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমি বই ক্রয় বিক্রি করছি। এখানে সব ধরনের বই বিক্রি করি। এখানে পাওয়া যায় না এমন কোনো বই নেই। যেসব বই আর নতুন পাওয়া যায় না, সেগুলার পুরান সংস্করণও এইখানে আছে। তবে, খুঁজে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দোকানে এমন ছাত্রও আছে যে, ক্লাস ফাইভ থেকে এখানের বই নিয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার, ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। পরে তারা আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে এসে দেখা করে গিয়েছেন।’
নীলক্ষেতের আরেকজন পুরোনো বই বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি নীলক্ষেত পুরাতন বই বিক্রয় করি গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে। এখানে বই বিক্রয় করে অনেক অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি জমা হয়েছে। আমরা যেভাবে শিক্ষার্থীদের বই দিয়ে থাকি সেটাকে ভাড়া দেওয়া বলা যায়। এই ধরণের একজন শিক্ষার্থী আমাদের কাজ থেকে প্রথম বর্ষের বই নিলো। সে যে দামে আমাদের কাজ থেকে বই নিয়েছে তার অর্ধেক দামে আবার আমাদেরকে দিয়ে আবার কিছু টাকা যোগ করে নতুন বর্ষের বই নিতে পারে। এতে আমাদের কিছু লাভ হয়, আর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ঠিক মত হয়। কারণ এমন অনেকেই আছে যে, নতুন বই কিনতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা যতদিন এই নীলক্ষেত থাকবে ততদিন এই পুরাতন বই বিক্রির ঐতিহ্য টিকে থাকবে।