যাত্রীরা হুঁশিয়ার


এএইচএম নোমান

রাজনৈতিক দলই যে দেশ পরিচালনা করবে এ নিয়ে সবাই একমত। এতে কোন মতভেদ অন্তত কোন উচুঁ কাঠামোতে কেউরই নাই। তা সে ডান বাম মধ্য যা-ই হোক। উচুঁ কাঠামো প্রসঙ্গ টানলাম এই জন্য যে, বৈষম্যের বেড়াজালের কলা-কৌশল, নির্যাতন শোষণে অন্যায় অত্যাচারে শেকড় পর্যায়ের লেজুড়দের চাঁদাবাজি পেশী-শক্তি ইত্যাদি কারণে গ্রাম-ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গরীব পুষ্টিহীন নাগরিক ভোটারদের ভাত-কাপড়ের স্বাদ না পাওয়ায়, অধিকার সংরক্ষণ না থাকায় তারা বীতশ্রদ্ধ। উপরি কাঠামোর রাজনৈতিক নেতা উপনেতারা প্রশ্ন বিদ্ধ। ধনীদের উপরে গরিবের অন্তর-আস্থা কাজ করে না।

ঐক্যমতের উপরের কাঠামো ও নিচের প্রন্তিকদের বৈষম্য, নিরবে নিভৃতে থেকেই যায়। প্রান্তিক পর্যায়ের আম-জনতা বিচারে আচারে আইন-সালিশে, অসৎ দলবাজিদের ‘হাত বদল’র কাছে একেবারে অসহায়। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তি অকার্যকর। কেরোসিন তেলের মেশিন থেকে কখনই সরিষার তেল বের করা যায়না।

এজন্যই জুলাই আগষ্ট ২৪ এর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার সফল বিপ্লবের ফসল আন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্ভব। মাঠে ও দেশে বিদেশে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় আদর্শিকরা দীর্ঘ দিনের সমস্যা ও পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার-মেরামতে কেউই ভিন্ন মত পোষণ করছেনা। বক্তব্য শুধু কতদিন থাকবে অন্তবর্তী সরকার, কতদিন লাগবে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করতে।
এখানেই কারো কারো, ‘মন মানে না, দেরী আর সয়না, গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি—’।

পরিবর্তন আকাঙ্খিদের দেয়ালে গ্রাফিতে আছে ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ; যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ’। অন্তর্বতীকালিন সরকার এবং তৎকর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিশনরাও সতর্কভাবে বুঝতে হবে ‘শুন মহাজন আমরা অনেক জন’। ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনবো’।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে স্বপ্ন পূরণ এবং জীবনে সফল হতে হলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে অন্য এক বক্তব্যে তিনি বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে।

‘৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘নির্যাতনের জবাব হিংসায় নয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাদের জবাব দেওয়া হবে’। প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন ‘দলের দুষ্টদের টাইট দিয়ে রাখতে হবে। মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। আপনাদেরও বুঝতে হবে কী করলে জনগণ আপনাকে আরো পছন্দ করবে।’ আন্ত মতামত বিনিময়ে সমাজিক কাজে নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়ে গাছের চারা লাগানো, পরিবেশ রক্ষা, রাস্তাঘাট পলিথিন মুক্ত, খাল ও নদী পুন:খনন ইত্যাদি করতে হবে বলেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘অনেক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেন- আপনারা কত দিনে নির্বাচন চান। আমি উত্তরে বলেছি, অন্যায় দুর্নীতি সংস্কারের পর আমরা নির্বাচন চাই। আমরা ক্ষমতার জন্য অস্থির নই। এই অন্তবর্তিকালীন সরকার জোর করে ক্ষমতায় আসেননি। সংস্কার কাজে জামায়াত সহযোগিতা করবে। সংস্কারের জন্য আমরা ধৈর্য্য ধরব।’

শান্তির আহ্বান জানিয়ে ভারতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা শান্তিতে থাকুন, আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দিন।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই বলেছেন, দেশের মানুষ জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। দেশে নতুন উদ্যমে চাঁদাবাজি, ছিনতাই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্টের পূর্বে সাধারণ মানুষ আওয়ামী ফ্যাসিষ্টদের নিপীড়নে পতিত হয়ে বৈষম্যের শিকার হতো আর এখন বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতার লোভ-লালসা পূরণে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্যাতিত হচ্ছে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওনা হাসান তার পর্যবেক্ষণে বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও রাজনৈতিক দলসমূহ রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ করতে না পারার জবাবদিহীতায় আসা উচিত। এ প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দুই/একজন নেত্রীবৃন্দ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন,সংস্কার যা করেছে রাজনৈতিক দলই করেছে-যা করে তারাই করতে পারেন।

এক সভায় রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সংগঠক আলমগীর নয়ন বলেছেন, বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিচ্ছে। আমরা বলতে চাই, আগে সংস্কার করতে হবে, বিচার করতে হবে, তার আগে কোনো নির্বাচন দেওয়া যাবে না। বাম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স লিখেন, গত ৫৩ বছরে আমরা দেশে যে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। এখন এক দেশে দুই ধরনের অর্থনীতি চালু আছে। একটি হচ্ছে বড়লোকের অর্থনীতি আর অন্যটি বঞ্চিত মানুষের অর্থনীতি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার লোভে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার রুখতে চায়।

তিনি বলেন, প্রতিটি বিপ্লব মূলত হয় একটি আমূল সংস্কারের স্বপ্নকে সামনে রেখে। কিন্ত রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ স্বার্থে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার লোভে মানুষের আকাঙ্খাগুলো রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে, যে সংস্কার হলে তাদের ক্ষমতা কমে মানুষের অধিকার বাড়বে, তা তারা চায় না। আমরা আমাদের আইডিয়া নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছি, মতবিনিময় করছি, তৃণমূল শক্তিশালী করছি। সাংগঠনিক শক্তি অর্জন হলেই আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করব।

এদিকে মার্চ ফর ইউনিটি থেকে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের দাবি জানানো হয়। একই সভায় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন, তারা সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন সংবিধান গঠন করবেন এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ৭২ এর সংবিধান বাতিলের কোন প্রয়োজন নেই। তবে সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করা যেতে পারে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেন, জাতি একবারই স্বাধীন হয়। ’৭১-এর সঙ্গে ’২৪ এর তুলনা চলে না।

নির্বাচন কমিশন প্রধান এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, সরকার বা আদালত নিষিদ্ধ না করলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যেতে বাধা নেই।

এ সকল বিবিধ মত পথ দৃষ্টিকোণ চলছে এবং আরো চলবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের কাছে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, ‘দূর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার. লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার’!

২০২৪ জুলাই ৩৬ এর পূর্ববর্তী সব মামলা হামলার প্রায় সকলের খালাস এবং পরবর্তী সময়ে শত শত মামলা-হামলা চলছে। যা আম-জনতার কাছে পূর্বাপর সকল বিচারালয়-সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা প্রকাশ পাচ্ছে। এতে ক্রোধ ও প্রতিহিংসা প্রাধান্য ও আইনের শাসন প্রশ্ন বোধক হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন দূর না করা পর্যন্ত অন্য খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা কঠিন। যখন একজন ব্যক্তি সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করেন, জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়ই যদি উভয়ের দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হয়, তা হলেই উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালে ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তার মূল বক্তব্য বা দাবি ছিল সর্বক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের মানুষের মধ্যে বিরল ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৯০-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমেও জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ঐক্যমত আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এবারের ছাত্র আন্দোলনে ঠিক তেমনি ঐক্য গড়ে উঠেছে। একে ধারণ ও বহন করে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সচেষ্ট হতে হবে। এই সঙ্কটকালিন সময়ে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্য থেকেই সমাধান খুঁজে ছাত্র আম-জনতার চাওয়া পাওয়াকে প্রকৃত স্থান দিতে পারলে আমরা একটি টেকসই নতুন বাংলাদেশ খুঁজে পাব। আল্লাহ সহায় হোন।

এএইচএম নোমান, প্রতিষ্ঠাতা ডর্প, গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
E-mail: nouman@dorpbd.org

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts