রবিউল ইসলাম ও সুজন আলী, তারা একে অপরের বন্ধু। দুজনই বেড়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের একটি অনাথালয়ে। সেখানে থেকেই এবার এসএসসি পাস করেছে তারা। করেছে ভালো ফলাফলও। তাদের স্বপ্ন- নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, খুঁজে পেতে চায় হারানো পরিবারকে।
দুজনই পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফলাফল অনুযায়ী রবিউল পেয়েছে জিপিএ-৪.৩২ এবং সুজন পেয়েছে জিপিএ-৪.২৫।
তাদের অনাথালয়টির নাম ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী’। এটি পঞ্চগড় সদরের হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমূল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।
এই শিশু নগরীর আরো ৪ জন শিশু এ বছর এসএসসি পাস করেছে। তবে রবিউল ও সুজনের গল্পটা করুণ। বাকীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও এ দুজনের যেন কেউ নেই। এই শিশু নগরীই তাদের সব। তবে স্বজনদের খুঁজে পাবার প্রবল আকাঙ্খা তাদের।
রোববার (১২ মে) এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর এই প্রতিবেদক যান পঞ্চগড়ের এই শিশু নগরীতে। সেখানে কথা হয় রবিউল এবং সুজনের সঙ্গে।
রবিউলের বাবা পারভেজ ছিলেন ট্রাকের হেল্পার। ২০১৩ সালের দিকে পরিবারসহ ঢাকায় থাকতে শুরু করেন তারা। হঠাৎ করেই সেখান থেকে হারিয়ে যায় শিশু রবিউল, আর খুঁজে পায়নি পরিবারকে। অন্য পথশিশুদের সঙ্গে কোন এক রেল স্টেশনে পৌঁছলে সেখান থেকে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই শিশু নগরীতে আসে সে। তখন থেকেই রবিউলের সবকিছু এই শিশু নগরীই।
রবিউল জানায়, দেশের বাড়ি নোয়াখালী জেলায় এতটুকুই মনে আছে। বাবার নাম পারভেজ, মায়ের নাম মোছা. রেখা। বাবা-মাকে দেখলে চিনতে পারবো। কিন্তু তারা কোথায় আছে, কেমন আছে তাতো জানিনা। বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে। এখানে থাকা অনেকেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, স্বজনরাও আসে খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু ১১ বছরে আমার খোঁজ নেয়নি কেউ। খুব ইচ্ছে করে পরিবারকে খুঁজে পেতে। আমার বিশ্বাস একদিন ঠিকই খুঁজে পাবো বাবা-মাকে।
সুজন আলী জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি ছিলো নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলার ডাক্তারবাড়ি গ্রামে। ছোটকালে মা লাকী বেগমের মৃত্যুর পর তার বাবা খোরশেদ আলী আবার বিয়ে করেন। সে থেকেই পরিবারে অবহেলিত হয়ে পড়ে সুজন এবং তার বড় ভাই শাহিন। সেসময় তার এক ফুপু ঢাকায় থাকতেন। তার মাধ্যমে কাজ যোগ দেন এক গ্যারেজে। সেখানে মালিকের মারধর খেয়ে পালিয়ে যায় সদরঘাটে। সেখান থেকে এক সমাজকর্মীর মাধ্যমে ২০১৩ সালে এই মিশনে আসে সুজন।
সুজনের ভাষ্য, গত ১১ বছরে কখনো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, আমি কোথায় আছি তারা জানেনা। খুব মন চায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে, দেখা করতে। পড়ালেখা শেষে গ্রামে ফেরার ইচ্ছে আছে।
আহছানিয়া শিশু মিশন নগরীর তথ্য মতে, এবছর এখানকার ৬ জন এসএসসি পাস করেছে। একজন পেয়েছে জিপিএ-৫। গত বছরও ৬ জন এসএসসি পাস করে এখান থেকে। সে বছরও একজন জিপিএ-৫ অর্জন করে। শিশুদেরকে নগরীর অভ্যন্তরে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। বর্তমান এখানে ১৬০ জন শিশু রয়েছে। তাদের যাবতীয় খরচবহনসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে আহছানিয়া মিশন।
শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাঁই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হবার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে শিখে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দীপক কুমার রায় বলেন, অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ৬ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একজন জিপিএ-৫ সহ সবার ভালো রেজাল্ট এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে।