রুমন চক্রবর্তী : রাসেল ভাইপারের পর এক ধরণের স্থলচর শামুক নিয়ে কিশোরগঞ্জে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর-এমন গুজব ছড়িয়ে নির্বিচারে মারা হচ্ছে এগুলো। এমনকি কৃষি বিভাগও আফ্রিকান জায়ান্ট নামে পরিচিত শামুকটি মেরে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, আফ্রিকান জায়ান্ট শামুকের খারাপের চেয়ে ভালো গুণ অনেক বেশি। জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি মূল্যবান এ শামুককে ঘিরে রয়েছে বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। তাই তারা সকলের কাছে এটি ধ্বংস না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার সদর, তাড়াইল, হোসেনপুর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় শামুকগুলো বেশি দেখা যাচ্ছে। বাসাবাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে এগুলো।
তাড়াইল সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে- এ প্রতিষ্ঠানের পেছনের দেয়াল, স্যাঁতসেঁতে জায়গা ও বিভিন্ন গাছপালাতে ঝুলে আছে ঢাউস সাইজের বড় বড় শামুক।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের জানান, দিনের বেলায় দেয়ালে, ঘরের টিনে, গাছে ও নানা জায়গায় দলবেঁধে লুকিয়ে থাকে এগুলো। বের হয় রাতের বেলায়। হানা দেয় বাসাবাড়ি, দালানকোঠা, বাগান ও ক্ষেতখামারে।
স্থানীয় কৃষক আলিউর রহমান বাড়ির আশপাশ, সবজি ক্ষেত থেকে এসব শামুক অপসারণের কাজ করছেন। তিনি একটি বালতিতে শামুকগুলো একসাথে জড়ো করছেন, পরে মেরে ফেলবেন। তার দাবি, এসব শামুক পরিবেশ, ফসল, ঘরের আসবাবপত্র এবং দেয়ালেরও ক্ষতি করছে।
তিনি জানান, শুধু তিনিই নন এখানকার সবাই শামুকের অত্যাচারে এসব প্রতিদিন অপসারণ করছেন। সবারই ধারণা স্থলচর শামুকটি তাদের বাড়িঘর-আসবাবপাত্রসহ শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি করছে। তাই উপদ্রব ভেবে সবাই সেগুলো নির্বিচারে মেরে ফেলছে।
তাড়াইল বাজারের পাটপট্টি, খাদ্যগুদাম ও মাখনাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার নারীরাও এসব শামুক ধরে লবণপানি ও ডিটারজেন্ট দিয়ে মেরে ফেলছে।
খাদ্যগুদাম এলাকার গৃহিনী শ্যামলী রানী দাস জানালেন, শামুকে তার একটি সবজি বাগানের যে কয়টা গাছ ছিল সবগুলো পাতা খেয়ে ফেলেছে। স্কুলের বেঞ্চ, টেবিল, দেয়াল বসে থাকে। শিশুরা ভয় পায়। শুধু তাই নয়, বইপত্র এমনকি কাগজপত্র খেয়ে ফেলে।
পাটপট্টি এলাকার কৃষক রহমত ব্যাপারী জানালেন, তিন মাসে তার ৩০টি পেঁপে ও ২৫টি আমের চারা খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে এই শামুক। তাই এগুলো চোখে পড়লেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন তিনি। কিভাবে এত এত শামুক এখানে আসলো, তিনি বলতে পারছেন না। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই এখানে এসব শামুক তিনি দেখতে পাচ্ছেন।
এদিকে এসব শামুকে অতিষ্ঠ হয়ে গত ২৩ জুন স্থানীয় কৃষি অফিসে লিখিত আবেদন করে ‘অরণ্য’ নামে একটি পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এগুলো আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক। তাদের দাবি-এসব শামুক পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য ও কৃষির জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই শামুক ছড়িয়ে পড়লে হুমকির মুখে পড়বে গোটা কৃষি ব্যবস্থা। এ বিষয়ে তারা কৃষি বিভাগের পরামর্শ চেয়েছে।
তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার সাহাও শামুকটি আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক বলে শনাক্ত করেছেন। তিনি এ শামুকটি ক্ষতিকর দাবি করে বলেন, এ শামুকের উপদ্রব নিয়ে তারা উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনা করেছেন। এটি যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ কাজ করছে।
তবে কৃষি বিভাগ ও সাধারণ মানুষ আফ্রিকান জায়ান্ট শামুককে কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, এ শামুক মোটেও ক্ষতিকর নয় বরং জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের পক্ষে সহায়ক।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকান শামুকটি। এ সময়ে শামুকটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের। তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বাগান ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। জানাশোনা ও গবেষণা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও শামুকটিকে ক্ষতিকর আখ্যা দিয়ে ধ্বংসের কথা বলা হয়।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ সালাম জানান, এটি আফ্রিকান জায়ান্ট ল্যান্ড স্নেইল। তখন এসব নিয়ে দেশে গবেষণা না থাকায় এটিকে ধ্বংসের কথা বলা হয়েছিল।
এ আফ্রিকান শামুক নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দীর্ঘদিন বিস্তর গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ড. এম এ সালাম। তিনি বলছেন, এ শামুক মোটেও ক্ষতিকর নয়। বরং পরিবেশ, জীব-বৈচিত্রের জন্য সহায়ক। এ শামুকের মাংস খুবই মূল্যবান, মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী। বিশ্বের অনেক দেশে এর লালা থেকে তৈরি পাউডার উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। আফ্রিকায় এ শামুকের খামার রয়েছে। আমাদের দেশে এটি হতে পারে লাভজনক বাণিজ্যখাত। কাজেই গুজবে কান দিয়ে এগুলো ধ্বংস করা যাবে না। পরিকল্পিতভাবে এগুলোর চাষাবাদ বাড়ানো দরকার। এ অবস্থায় আফ্রিকান শামুক ধ্বংস না করেও বাগান কিংবা গাছপালা রক্ষা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে বন ও কৃষি বিভাগকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভূমিকা রাখা জরুরী।