চটপটে নাদুস-নুদুস চেহারার একজন নতুন মুখ খুঁজছিলেন হুমায়ূন স্যার। নতুন এ অভিনেত্রীকে দিয়ে তার সিনেমায় কাজ করাবেন। কিন্তু মনের মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর আমার বড় ভাই চ্যালেঞ্জারকে বললেন, ‘তুমি তো কোনো দিন অভিনয় না করেও ফাটিয়ে দিলে, এবার খুঁজে দেখো তো একজন চটপটে স্বভাবের মেয়ে তোমার জ্ঞাতিগোষ্ঠীতে পাও কি না।’
তারপর ভাই আমাকে স্যারের কাছে যেতে বললেন। সঙ্গে এও বলেন, ‘তুমি যে অভিনয় করতে পারবে তা কিন্তু না। কারণ পছন্দ না হলে তোমাকে বাদও দিতে পারেন। অভিনয় তুমি না করতে পারলেও সমস্যা নেই। স্যার অন্তত তোমার অভিনয় দেখুক।’ পরে আমি শুটিং সেটে যাই, আসলে নায়ক-নায়িকা দেখার জন্য। কারণ তখন পর্যন্ত কাছ থেকে কোনো নায়ক-নায়িকাই দেখি নাই। তারপর গেলাম। স্যার দেখেই বললেন, ‘ও তো উঁচা-লম্বা আছে। ফর্সাও। ওকে ফিল্মের চড়া মেকআপ করে দাও।’
এভাবে স্যারের সঙ্গে কাজ করা শুরু করি। স্যারের সাথে ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’ নাটকে আমি প্রথম অভিনয় করি। এ নাটকে প্রথম সিকুয়েন্সের শট শেষ হলে হুমায়ূন স্যার আমার ভাইকে বলেছিলেন, ‘তোমার বোন তো কখনো অভিনয় করেনি কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ও সারাক্ষণ অভিনয়ের মধ্যেই থাকে।’
এরপর ‘বৃক্ষমানব’ নাটকে অভিনয় শুরু করি। তখনো তো আমি একদম নতুন। ওই নাটকের প্রধান চরিত্রে কাজ করেছিলাম। নাটকে কাঁদার দৃশ্য ছিল কিন্তু তখনো কীভাবে কাঁদতে হয় তা আমি ভালোভাবে শিখিনি। কিন্তু নাটকের সংলাপ এমন ছিল যে, আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। এ দৃশ্য শেষ হলে স্যার টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিলেন। পরে আমার সহকর্মীদের স্যার বলেছিলেন, ‘ও যদি আরো আগে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আসত, তবে ও আজ অনেক বড় মাপের অভিনেত্রী থাকত।’ স্যারের এই মন্তব্য শোনার পরই মূলত মনে সাহস পেয়েছিলাম যে, হ্যাঁ, আমি অভিনয় করব। আমি অভিনয় শিখব। আমি পারব।
এরপর ‘চন্দ্রকথা’ সিনেমায় অভিনয় করি। এ সিনেমায় সবচেয়ে বেশি সংলাপ আমার ছিল। তখন রিল কোনটা সেটাই বুঝি না। তখন প্রতি রিলের দাম ছিল ৮-১০ হাজার টাকা। শটটা ঠিকমতো না হলে রিল নষ্ট হয়, তা বুঝতাম না। তারপর তিনটা সিকুয়েন্স করে ফেলি। এরপর স্যার বলেন, ‘মিঠু, তোমার তিনটা সিকুয়েন্স খুব ভালো হয়েছে। তোমার জন্য গিফট আছে।’ এদিন সন্ধ্যার দিকে স্যার আমাকে একটি বই গিফট করেন। এই বইয়ে লেখা ছিল, ‘জীবন আনন্দময় হোক’। পরে বুঝতে পেরেছি মানুষের জীবনে এটা সবচেয়ে মূল্যবান একটি বিষয়। আসলে যে জীবনে আনন্দ নাই সে জীবনের কোনো মানে নাই। স্যারের এই একটা কথা আমার জীবনে অনেক গুরুত্ব বহন করছে।
আমার জন্মদিন আমি কখনো ঘটা করে পালন করি নাই। একবার আমার জন্মদিনে নুহাশপল্লীতে শুটিং করছিলাম। এ বিষয়টি স্যারকে কিছু বলিও নাই। কিন্তু স্যার যেন কীভাবে শুনেছিলেন তা আমি জানি না। সন্ধ্যায় স্যার আমাকে বৃষ্টিবিলাস বাংলোতে ডেকে পাঠালেন। শীতের সময় ছিল। এরপর আমি গেলাম। গিয়ে দেখি পুরো মাটির দেয়াল মোমবাতি জ্বালানো। স্যার এই মোমবাতি বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে জ্বালাতেন। যাওয়ার পর সবাই চিৎকার করে উঠে আমাকে শুভেচ্ছা জানান। তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে সবাই রেডি। এরপর স্যার ওই দিনের শুটিং প্যাকআপ করে দেন। গানবাজনা করেন। এভাবে স্যার আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ওই জন্মদিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জন্মদিন।
সূত্র : রাইজিংবিডি